“খাঁটি সোনা ছাড়িয়া যে নেয় নকল সোনা সে জন সোনা চেনে না”। স্বর্ণের বিশুদ্ধতার সাথে তুলনা হয় না আর কোন কিছুর। তাই তো যুগ যুগ ধরে স্বর্ণের বিশুদ্ধতার মাপকাঠিতে পরিমাপ করা হয় মানুষের ভালোবাসার, দেশপ্রেমের, মায়ের স্নেহের। কখনো কি চিন্তা করে দেখেছেন কেন স্বর্ণের বিশুদ্ধতার মাপকাঠিতেই খাঁটি হওয়ার পরিমাপ করা হয় কেন রৌপ্য, লোহা, প্লাটিনাম এসব দিয়ে পরিমাপ করা হয় না? স্বর্ণ যে অতন্ত্য দামী বস্তু তা আমরা সবাই জানি। দুইদিন পর পর লাফ দিয়ে শুধু বাড়ছেই এর দাম। কিন্তু এটি কেন এত দামী?
স্বর্ণ খুবই মুল্যবান ও বিরল প্রজাতির ধাতু। বিজ্ঞানীদের ধারণা এর সৃষ্টি পৃথিবীতে হয় নি। কোটি বছর পূর্বে দুইটি নিউট্রন তারার সংঘর্ষের পর তা থেকে ছিটকে স্বর্ণ পৃথিবীতে এসে পড়ে। প্রথমে সোনা বায়বীয় অবস্থায় থাকলেও পরবর্তীতে তা শীতল হয়ে কঠিন পদার্থে রুপান্তর হয়।
আমেরিকার জিওলজিকাল সার্ভের মতে৷ এখনো পৃথিবীতে সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার টন স্বর্ণের মজুদ আছে যা প্রায় ২০ বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। প্রাচীন মিশরে স্বর্ণকে দেবতাদের অংশবিশেষ ভাবা হত। তাই দেবতাদের মুখে স্বর্ণের মুখোশ পড়িয়ে দেয়া হত।
প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষের আকাংক্ষিত এই স্বর্ণ মূল্যবান ধাতু হওয়ার বেশ কিছু কারণ আছে।
অক্ষয়
স্বর্ণ সাধারণ অবস্থায় কোন কিছুর সাথে বিক্রিয়া করে না। সাধারণত বেশির ভাগ জিনিসই অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে সময়ের সাথে সাথে ক্ষয় হতে থাকে। স্বর্ণ এ দিক দিয়ে অনন্য। অক্সিজেনের সাথে এটি বিক্রিয়া করে না। ফলে হাজার বছর ধরে এটি দেখতে ও ওজনে অবিকল একই থাকে।এমনকি কোনো এসিড দিয়েও স্বর্ণের ক্ষতি করা যায় না। শুধুমাত্র হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও নাইট্রিক এসিডের মিশ্রণের সাথে স্বর্ণ বিক্রিয়া করে। এই দুইটি এসিডের মিশ্রণকে এ্যাকুয়া রিজিয়া বলে। অন্যান্য ধাতু যেমন লোহা সাধারণ পরিবেশে অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে ক্ষয় হয়, কপার অক্সিডাইজ হয়ে যায়। সেখানে সাধারণ পরিবেশে স্বর্ণ কোনো ধরনের ক্ষয় হয় না বা ওজনে কমে না। তাই এর মুল্য অনেক। স্বর্ণের এই গুণের জন্য এটি বিনিময়ের জন্য সবচেয়ে যোগ্য মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হত।
দুষ্প্রাপ্য ও প্রকৃতিতে সীমিত
স্বর্ণ শুধু দুষ্প্রাপ্যই নয় এটি প্রকৃতিতে সীমিত। ধারণা করা হয় আর ২০ বছর পরেই শেষ হয়ে আসবে পৃথিবীর স্বর্ণ।
উত্তোলনে ব্যয়
স্বর্ণ মাটির নিচের খনি থেকে পাওয়া যায়। এর পুরো প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল ও ব্যয়বহুল। খনিতে স্বর্ণ বিভিন্ন মেটাল, সিলভার, মাটি ও অন্যান্য পদার্থের সাথে মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। স্বর্ণের সন্ধান পাওয়া গেলে বিজ্ঞানীরা ড্রিলিং এর মাধ্যমে মাটি থেকে স্যাম্পল কালেকশন করে জানার জন্য যে জায়গাটিতে কি পরিমাণ স্বর্ণ রয়েছে। যদি স্বর্ণের পরিমান বেশি হয় তবেই মাইনিং কোম্পানিগুলো বড় আকারে মাইনিং অপারেশনের কাজ শুরু করে। খুবই সাবধানতার সাথে উচ্চ তাপ ও চাপের মাধ্যমে সোনাকে এর থেকে আলাদা করা হয়। তারপর অনেক ধাপের পর স্বর্ণকে বিশুদ্ধ রুপে পাওয়া যায়।
চাহিদা ও সীমিত যোগান
কোন জিনিসের মুল্য নির্ধারণ হয় দুইটি জিনিসের উপর ভিত্তি করে। চাহিদা ও প্রাচুর্যতা। যে জিনিস প্রকৃতিতে প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায় তার মুল্য কমই হয় যেমন অ্যালুমিনিয়াম। যদিও অ্যালুমিনিয়ামের প্রাচুর্যতা বেশি কিন্তু এর জনপ্রিয়তা অনেক বলে এর চাহিদাও তুঙ্গে। স্বর্ণের বিরল গুণাবলীর জন্য বিশ্বে স্বর্ণের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজেদের কাছে স্বর্ণ মজুদ রাখে। এছাড়া উপমহাদেশীয় রাষ্ট্রগুলোতে মানুষের কাছে স্বর্ণের প্রচুর চাহিদা থাকে। এমনকি স্বর্ণ ছাড়া বিয়ের মত রীতি নীতিও আটকে যায়। তবে অধিক চাহিদা থাকলেও যোগান সীমিত। তাই স্বর্ণের দাম ক্রমশ বেড়েই চলছে।
যে কোনো আকৃতি দেওয়া সহজ
স্বর্ণ ধাতুটি খুবই নরম প্রকৃতির তাই একে যে কোন আকৃতি দেওয়া যায়৷ বিভিন্ন আকৃতির ছাঁচে ফেলে তাই স্বর্ণের অলংকার বানানো হয় তাই হাজার বছর আগ থেকে।
ইলেকট্রনিক জিনিসে ব্যবহৃত হয়
মোবাইল বা ইলেকট্রনিক জিনিসের সার্কিট তৈরী করা হয় স্বর্ণের প্রলেপ দিয়ে।
ইনভেস্টমেন্ট
টাকা পয়সার মুল্য বিশ্বের নানা রকম পরিস্থিতি সাপেক্ষে বাড়ে কমে। কিন্তু স্বর্ণ এমন এক জিনিস যার মুল্য কখনই কমে না। তাই অনেক মানুষই ইনভেস্টমেন্টের জন্য স্বর্ণকে বেছে নেয়। কারণ সময়ের সাথে এর দাম শুধু বেড়েই চলে। স্বর্ণে বিনিয়োগ কখনোই অলাভজনক হবে না। কাগজের টাকার মুল্য সবসময় নাও থাকতে পারে। কিন্তু স্বর্ণ আদি যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত সব যুগেরই সম্পদ। অনিশ্চিত সময়ে বিভিন্ন দেশ স্বর্ণে বিনিয়োগ বাড়ায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গুলো স্বর্ণ মজুদ করে। সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ বর্তমানে চীনের কাছে মজুদ আছে।
জ্বালানি তেল
স্বর্ণের সাথে সরাসরি সম্পর্ক জ্বালানি তেলের। তেলের দাম বাড়লে স্বর্ণের খনিতে মাইনিং, স্বর্ণ উৎপাদন ও যাতায়াত খরচও বেড়ে যায়। এতে স্বর্ণের দামও বাড়ে।
খাদ্যে স্বর্ণ
ইদানীং অনেক রেস্টুরেন্টে দেখা যায় স্বর্ণ মিশ্রিত খাবার। এডিবেল গোল্ড দিয়ে তৈরি হয় স্টেক, কফি, কেক আরও কত কি! তবে শুধুই খাবারে আভিজাত্য প্রকাশের জন্যই খাবারের সাথে স্বর্ণের মিশ্রণ ঘটানো। স্বর্ণ রাসায়নিকভাবে প্রায় নিষ্ক্রিয়, তাই খাবার হিসেবে এটা ক্ষতিকর নয়। ২৪ ক্যারেট স্বর্ণকে বলা হয় সবচেয়ে বিশুদ্ধ স্বর্ণ। কারণ, এতে অন্য কোনো মৌল বা খাদ মিশ্রিত থাকে না। এ কারণে খাবার হিসেবে ২৪ ক্যারেট স্বর্ণকে বৈধতা দেন বিশেষজ্ঞরা। এরচেয়ে কম ক্যারেটের স্বর্ণ খাওয়া উচিত নয়।
ঔষুধ
ঔষুধ হিসেবেও সোনার ব্যবহার করা হত। বিংশ শতাব্দীর পূর্বে গুটিবসন্ত, সিফিলিস, হ্রদরোগ ইত্যাদি রোগ নিরাময়ে স্বর্ণ ব্যবহার করা হত। বলা হত খাঁটি স্বর্ণ নিয়ে কোনো ক্ষতের উপর রাখলে তা ক্ষত সারিয়ে তুলতে বা সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করে। আধুনিক মেডিকেলের তথ্য অনুযায়ী স্বর্ণ কোষের পুনর্গঠন ও কোষের ক্ষয় রোধে সাহায্য করে। শরীরে কোনো পার্শপ্রতিক্রিয়া করে না এবং সহজেই হজম হয়ে যায়। দাঁতের চিকিৎসায় বা নকল দাঁত লাগানোর প্রয়োজন হলে তাই স্বর্ণ ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও ক্যান্সারের চিকিৎসায় ও রেডিও একটিভ গোল্ড আইসোটোপ ব্যবহার করা হয়।
ধর্মীয় গুরুত্ব
বিভিন্ন জাতি ও ধর্মে স্বর্ণের আলাদা মর্যাদা রয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে স্বর্ণ সৌভাগ্য ও উন্নতির প্রতীক। চীনাদের কাছে সোনালি রঙ একটি রাজকীয় ও ক্ষমতার চিহ্ন বহন করে বলে চীনাদের কাছে স্বর্ণের বিশেষ মুল্য রয়েছে। এটি এমন এক ধরনের ধাতু যার চকচকে রঙ অন্য যে কোন ধাতু থেকে একে আলাদা ও নজরকাড়া করে তোলে। তাছাড়াও এটি ধরতে এক ধরনের আভিজাত্য অনুভূতি হয় যার জন্য প্রাচীনকালে রাজ বংশে স্বর্ণের তৈরি অলংকার, মুদ্রা, আসবাবপত্রের ব্যবহার ছিল প্রচুর।