যেভাবে এল ট্যাটু বা উল্কি আঁকার প্রচলন

ট্যাটু

বর্তমানে ফ্যাশনিস্তা বা সুপার কুল হওয়ার জন্য নানা সময়ে চলে নানান রকমের ট্রেন্ডের বাতাস।

প্রাচীন কীর্তিকলাপ আবার ফিরিয়ে আনার মধ্যেও থাকে এস্থেটিক ভাব।  হালের অন্যতম একটি ট্রেন্ড হল ট্যাটু বা বাংলায় যাকে বলে “উল্কি”। পছন্দের কোনো অক্ষর, প্রিয় কোনো উক্তি বা ছবি, ভালোবাসার মানুষের নাম অথবা আধ্যাত্মিক কোনো চিহ্ন নিজের শরীরে খোদাই করার মাধ্যমে নিজের পরিচয় তুলে ধরতে চায়। হাজার বছরের পুরানো সংস্কৃতি আবার যেন নতুন করে ঢেউ তুলেছে ট্রেন্ড্রের দুনিয়ায়।

হালের ট্রেন্ড ট্যাটু পুরো শরীর জুড়ে;Image Source: Pickpic

পলিনেশিয় শব্দ Tatao থেকে ইংরেজি Tatto শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ হল বৈশিষ্ট সূচক চিহ্ন বা টোকা। ক্যাপ্টেন জেমস কুক ১৭৬৯ সালে প্রথম এই শব্দটি উদ্ভাবন করেন।

প্রাচীন ট্যাটু বা উল্কি হল মূলত অমোচনীয় কালি দ্বারা মানবদেহে অংকন। কিন্তু বর্তমানে নানারকমের কালি দ্বারা সাময়িকভাবেও ট্যাটু করা যায়।

উৎস

বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেছিল ট্যাটু বা উল্কির প্রথম প্রচলন হয় প্রাচীন মিশরে। খ্রীস্টপূর্ব প্রায় ৪০০০ বছর আগের মমির গায়ে উল্কির প্রমাণ পাওয়া যায়। সে সময় মিশরের সামাজে শুধু মেয়েরাই সাধারণত শরীরে উল্কি আকত। বেশির ভাগই ছিল উচ্চবংশীয় নারী বা গর্ভবতী নারীরা, যাতে সন্তান জন্ম দানের সময় বা গর্ভাবস্থায় কোনো অশুভ শক্তি বাচ্চার ক্ষতি না করতে পারে। পরবর্তীতে গর্ভবতী নারীর তলপেট বা উরুর চারপাশে উল্কি দেখে এই ধারণা করা হয়। এছাড়াও পতিতা বা যৌন রোগ বিশিষ্ট নারীদের আলাদা ভাবে চিন্তিত করার জন্যও উল্কি কা হত তাদের শরীরে।

তীক্ষ্ণ সূচ কালিতে ডুবিয়ে দেহে ক্ষত করার মাধ্যমে আঁকা হচ্ছে ট্যাটু; Image Source: Pexels

তবে ট্যাটু বা উল্কির উৎস নিয়ে আরেকটি ধারণাও রয়েছে। নব্বই দশকের শুরুতে দুইজন জার্মান পর্বতারোহী আল্পস পর্বতমালার ওটস উপত্যকায় বরফ চাপা পড়া একজন মানুষের মৃতদেহ আবিষ্কার করে। বরফের নিচের অতি শীতল তাপমাত্রায় দেহটি জমে মমির ন্যায় হয়ে গিয়েছিল এবং অক্ষত ছিল। মানুষটির নামকরণ করা হয়” ওটস দি আইসম্যান” বা ” বরফ মানব ওটস”। ধারণা করা হয় এই মানুষটির দেহ অন্তত ৫২০০ বছর আগের। ‘ওটস দি আইসম্যানের’ দেহে ৫৭ টি উল্কি অংকন করা ছিল যা আগের সব তথ্য উপাত্ত পালটে দেয়।  বিশেষজ্ঞরা তখন নতুন ধারনায় উপনীত হয় যে এটিই সবচেয়ে প্রাচীন উল্কির প্রমাণ।

পৃথিবীর নানা দেশের অনেক উপজাতি গোষ্ঠীর হাত ধরেই মূলত শুরু হয়েছে ট্যাটু অংকনের প্রচলন। আবার প্রাচীন ইতিহাসের বিভিন্ন জায়গায় ট্যাটু অংকনকে ট্যাবু হিসেবে ধরা হত। জুডিয়াজম ও খ্রিস্টান ধর্মে ট্যাটু করা নিষিদ্ধ ছিল।

বিভিন্ন দেশে ট্যাটু

প্রথম খ্রিস্টান শাসক প্রাচীন রোমের রাজা, কন্সটানটিন ৩১৬ সালে মুখমণ্ডলে ট্যাটু কা নিষিদ্ধ করেন।

প্রাচীন চীনে মহিলারা সারা দেহে ও মুখে ট্যাটু করত যাতে তাদের কুৎসিত দেখায় এবং তৎকালীন রাজাদের হাত থেকে বাঁচতে পারে। চাইনিজদের ট্যাটু করাকে বলা হয় “চি শেন”।

জাপানে ট্যাটু আকা ঐতিহ্যবাহী শিল্প। কিন্তু ৭০০ সাল থেকে ১৭০০ সাল পর্যন্ত জাপানে ট্যাটুর প্রচলন পড়ন্ত হয়ে যায় কারণ জাপানিজ নীতিনির্ধারকরা ঠিক করে ট্যাটু অংকনের এই প্রক্রিয়াটিকে ক্রিমিনালদের শাস্তি দেওয়ার উপয়ায় হিসেবে ব্যবহার করা হবে। জাপানের এই ধরনের ট্যাটুকে বলা হয় ইরেজুমি। পরবর্তীতে এই ধরনের ট্যাটু ব্যান করা হয়।

বিভিন্ন রকম ট্যাটু বহন করত ভিন্ন ভিন্ন বার্তা ও ঐতিহ্য; Image Source: Public Domain

থাইল্যান্ডের মানুষ আধ্যাত্মিক শক্তি পাওয়ার আশায় শরীরে ট্যাটু খোদাই করত যাতে তারা খারাপ আত্মা বা শয়তানের হাত থেকে বাচতে পারে।

ভারতের অনেক উপজাতি হাজার বছর ধরে বংশ পরম্পরায় ট্যাটু অংকন প্রথা ধরে রেখেছে। ভারতের নাগা উপজাতির হেড হান্টার নামক একটি গোষ্ঠী নিজেদের মুখে ট্যাটু করে নিজেদের আলাদা পরিচয় তুলে ধরত। মধ্যপ্রদেশের ডিন্ডোরি নামক জেলার বাইগা নামক উপজাতিতে মহিলাদের পুরো দেহে ট্যাটু অংকন করায়। অদ্ভুত কথা হল, সেখানের শুধুই মহিলারা ট্যাটু করাতে পারবে এবং ট্যাটু করানোর সময় কোনো পুরুষের তা দেখার সুযোগ নেই। তারা কাজলের কালি দিয়ে ট্যাটু করায়।

যুক্তরাষ্ট্রে মার্টিন হিডেব্রান্ট নামক এক ব্যাক্তি প্রথম নিউ ইয়র্কে ট্যাটুর প্রথা শুরু করে। সে বেশির ভাগ  সৈনিকদের ট্যাটু একে দিত। ১৯৬১ সালে নিউ ইয়র্কে অফিশিয়ালি ট্যাটু ব্যান করা হয়। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সেখানে ট্যাটু করা ছিল আইন বিরোধী কাজ। পরবর্তী সময়ে ট্যাটু অংকন করা আমেরিকার মেইনস্ট্রিম কালচারের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে আমেরিকার মোট জনসংখ্যার ৩২% এর শরীরে ট্যাটু অংকিত রয়েছে৷

কিভাবে আঁকা হত প্রাচীন ট্যাটু

প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ট্যাটু অংকনের পদ্ধতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে৷ বর্তমানে যতটা সম্ভব কম যন্ত্রণাদায়কভাবে অত্যন্ত সাবধানতার সাথে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন যন্ত্রপাতির মাধ্যমে মানবদেহে ট্যাটু বা উল্কি অংকন করা হয়। কিন্তু প্রাচীনকালে এ পদ্ধতি ছিল প্রচন্ড যন্ত্রণাদায়ক। প্রাকৃতিক উপাদানের মাধ্যমে বিভিন্ন চিত্র দেহে খোদাই করা হত। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ভাবে আঁকা হত ট্যাটু। বর্তমানেও পৃথিবীর বেশ কিছু জায়গায় কিছু গোষ্ঠী এখনও প্রাচীন নিয়মে উল্কি করে। কিছু সাহসী মানুষ প্রাচীনতার নির্যাস নিতে সেসব স্থানে প্রাচীন নিয়মে উল্কি করায়।

জাপানিজ সংস্কৃতি:

৪০ বছর আগ পর্যন্ত জাপানিজরা হাত দিয়ে ট্যাটু অংকন করত। জাপানে প্রথম বাঁশের হাতল দিয়ে ট্যাটু করার পদ্ধতি প্রচলন শুরু হয়৷ একটি বাঁশের হাতলের মাথায় প্রায় ২৪ টি তীক্ষ্ণ প্রান্ত থাকে যা সূচ হিসেবে কাজ করে। এতে কালি লাগানো থাকে যা শরীরের চামড়া ভেদ করে ভেতরে কালি ঢুকিয়ে দেয়।

এশিয়ান সংস্কৃতি:

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে থাইল্যান্ডে এ ধরনের ট্যাটু প্রথম লক্ষ্য করা যায়৷ এ অঞ্চলে মেটাল টিউব পদ্ধতিতে ট্যাটু করা হত। একটি খালি মেটালের টিউব আরেকটি তুলনামুলক চিকন মেটালে অংশের সাথে যুক্ত থাকে৷ চিকন মেটালের শেষপ্রান্ত তীক্ষ্ণ সূচের মতন হত যা কালির ডাইয়ে ডুবিয়ে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে উল্কি অংকন করা হত।

মিশরীয় সংস্কৃতি:

মিশরীয় সংস্কৃতিতে দুটি কৌশলে ট্যাটু করা হত। একটি হল সেলাই অপরটি হল পাংচার পদ্ধতি।

আমরা বর্তমানে যেভাবে সেলাই করি ঠিক সেভাবেই মানবদেহে লাইন তৈরি করা হত। একটি সুতলিকে ছাইয়ে ডুবিয়ে আরো গাড় কালো করা হত। এরপর সুচটিকে চামড়ার ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেই তা ত্বকে আটকা পড়ে লাইনের কালো দাগ সৃষ্টি করত।

অপর প্রক্রিয়াটি হল পাংচার পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে একটি পিন বা সূচ দ্বারা ত্বকে ছোট ছোট ফুটা করে ছবির মতন আঁকা হয়৷ ফুটা করার আগে সূচ বা পিনটিকে কালির মধ্যে ডুবিয়ে নেয়া হত যাতে অংকনটি দৃশ্যমান হয়।

সামোয়ান সংস্কৃতি:

সামোয়ান সংস্কৃতিতে নিড়ানি সদৃশ জিনিস দিয়ে ট্যাটু করা হত। একটি কাঠের হাতলের মাথায় নিড়ানির মত সূচালো অংশ যুক্ত থাকত৷ ট্যাটুতে ভিন্ন রকম আকৃতি দেওয়ার সময় এই প্রক্রিয়াটি খুবই যন্ত্রনাদায়ক।

মাওরি সংস্কৃতি:

মাওরি গোষ্ঠী মূলত নিউজিল্যান্ডের উপজাতিদের বলা হয়৷ তাদের ট্যাটু সংস্কৃতি ঐতিহ্যবাহী ও তাদের ধর্মীয় রীতিনীতির সাথে যুক্ত। মাওরিদের ট্যাটু অংকনের পদ্ধতিকে বলা হয় “টোমাকো পদ্ধতি”। এ পদ্ধতিতে ত্বক কেটে তা ছাই দ্বারা পূর্ণ করে দেয়া হয়, যাতে তা স্থায়ী হয়।

মাওরি সংস্কৃতিতে মুখমন্ডলে ট্যাটু অংকন করা হত; Image Source: Public Domain

আধুনিক ট্যাটু অংকন পদ্ধতি

আপনি কি জানেন বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত টমাস এডিসন পরোক্ষভাবে বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত ট্যাটু গান আবিষ্কারের সাথে জড়িত?

১৮৭৫ সালে এডিসন যখন বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করেন তখন তিনি বৈদ্যুতিক কলমও আবিষ্কার করেন৷ কলমটির উপরের অংশে বৈদ্যুতিক মটর যুক্ত ছিল এবং এটি হাত দিয়েই কার্য সম্পন্ন করার মত যন্ত্রাংশ ছিল। এটি চালানোর জন্য ব্যাটারির এডভান্স জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তখন টাইপ-রাইটিং এর ভীষণ চল ছিল। তাই বৈদ্যুতিক কলমটির আবিষ্কার আর জনপ্রিয়তা পায় নি। প্রথম দিকে জনপ্রিয়তা না পেলেও এডিসনের বৈদ্যুতিক কলমের ডিজাইনের ১৫ বছর পর এই কলম থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তৈরি করা হল প্রথম বৈদ্যুতিক ট্যাটু গান।

ট্যাটু গান দিয়ে সতর্কভাবে খোদাই করা হচ্ছে নানা ডিজাইনের ট্যাটু Image Source: Flickr

১৮৯১ সালে স্যামুয়েল ও’রেলি প্রথম বৈদ্যুতিক ট্যাটু মেশিন উদ্ভব করেন। কলমের ছুচের মত তীক্ষ্ণ সুই মেশিনের সামনে যুক্ত করা হয় এবং তাতে কালি জমা থাকার ব্যাবস্থা করা হয়৷ এটি ত্বকের দ্বিতীয় স্তর, ডার্মিসে সুচের মাধ্যমে কালি প্রবেশ করানো হয় যা রক্ত নালী ও নার্ভের সাথে মিশে কালির ছাপ তৈরী করে স্থায়ীভাবে বসে যায়। বর্তমানে এই ট্যাটু গানের মাধ্যমে ত্বকে সেকেন্ডে ২০০ বার ছিদ্র করা সম্ভব।

কেনো করা হত ট্যাটু

অঞ্চলভেদে ট্যাটুর নানাবিধ ব্যবহার ছিল। কোনো সংস্কৃতিতে আধ্যাত্মিক, কোনো সংস্কৃতিতে আলাদা বংশীয় মর্যাদা নির্ধারক, কেউ বা কুসংস্কার বশত বা কেউ চিকিৎসাক্ষেত্রে দেহে ট্যাটু খোদাই করত। কোনো কোনো সংস্কৃতি বা অঞ্চলে এটি আবার নিষিদ্ধ প্রথাও।

সিনেমা রেফারেন্স

এনিমেটেড জনপ্রিয় মুভি “মোয়ানা” তে পলিনেশিয়ান উপজাতীয় সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়। দুরন্ত এক কিশোরী মোয়ানা পরিবার, সমাজের শত মানা, বাধা বিপত্তি ভেংগে সমুদ্রে পাড়ি জমায়। পথিমধ্যে মোয়ানা খুজে পায় উপদেবতা মাউয়িকে। মাউয়ির সারা দেহে ছিল নানা রকম উল্কি,  যখনই সে নতুন কিছু অর্জন করত তা তার শরীরে উল্কি হয়ে নিজ থেকেই চিত্রিত হয়ে যেত। মুভিটি পলিনেশিয়ান মিথ থেকে উজ্জীবিত  হয়ে বানানো হলেও বেশ কিছু মানুষ এটি থেকে পলিনেশিয়ান সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হয়।  জানা যায়, পলিনেশিয়ান উপজাতিদের মধ্যে কিছু অর্জনের পরে তা সম্মান হিসেবে শরীরে উল্কি অংকনের দ্বারা প্রকাশ করা হত। এছাড়াও হ্যারি পটার সিরিজে খলনায়ক ভল্ডেমর্ট ও তার দলের লোকদের আলাদা ভাবে চিন্তিত করার জন্য হাতে কালো যাদুকর দলভুক্ত হওয়ার উল্কি খোদাই করা থাকত। যা এক কালে তন্ত্র মন্ত্রে উল্কি আঁকার প্রচলনকে নির্দেশ করে।

হ্যারি পটার সিনেমায় কালো যাদুকর ভল্ডেমর্টের প্রতীক হাতের ট্যাটুতে; Image Source: Wikimedia Commons

ক্ষতি

ট্যাটুতে যে কালি ব্যবহার করা হয় তাতে মেশানো থাকে নানা রকম রাসায়নিক পর্দাথ। স্থায়ী ট্যাটুতে তা শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে অনেক দিন পর্যন্ত শরীরে ক্রিয়া করতে থাকে যা বিভিন্ন অসুখ এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।  সুচ পরিষ্কার না থাকলে তা থেকে এইডস, হেপাটাইটিস, টিটেনাস এর মত জটিল রোগের সংক্রমণের আশংকা ও রয়েছে। বিভিন্ন চিকিৎসকের মতে এটি জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তাই বিভিন্ন দেশে ট্যাটু করা নিষিদ্ধ বা ১৮ বছরের পূর্বে ট্যাটু করার অনুমতি নেই৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top