“মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ছাড়ছে দেশটির জনগণ, চলছে এমন এক সংকট যা বিশ্ববাসী দীর্ঘদিন ধরে অবহেলা করছে!” “আশংকাজনক হারে বাড়ছে অপহরণ, এ যেন মৃত্যুপুরী!” “গৃহযুদ্ধে হাজার মানুষ ছাড়ছে দেশ, প্রতিবেশী দেশের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়!”- বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিগত কয়েক দশক ধরে বারবার দেশটির প্রবল অস্থিতিশীল পরিস্থিতি উঠে আসছে। দেশটির জনগণকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতা, বারবার গৃহযুদ্ধ, অর্থনৈতিক ধ্বস দেশটির ভর সার্বিক পরিস্থিতির জানান দিচ্ছে বিশ্বকে। আসলে কি হচ্ছে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে? হীরা, স্বর্ণের মত সবচেয়ে মুল্যবান সম্পদের খনির মালিকানা সত্ত্বেও কেন স্বাধীনতার ৬৪ বছরেও অর্থনৈতিক ভাবে ভয়ংকরভাবে বিপর্যস্ত দেশটি? কেন নিরাপত্তা দিতে পারছে না দেশের জনগণকে? তবে কি রাষ্ট্র হিসেবে ব্যর্থ মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ?
বর্তমান পরিস্থিতি
International Monetary fund (IMF) ২০২৩ এর ৫ নভেম্বর বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে যার মধ্যে মাথা পিছু ১৩০০ ডলার জিডিপি নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র। হীরা, স্বর্ণ, ইউরেনিয়াম সহ আরও অনেক প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক আফ্রিকা মহাদেশের এই দেশটি জন্মলগ্ন থেকেই লড়ছে নানাবিধ শক্তির সাথে।
দেশটিতে ক্ষমতা নেয়া দুর্নীতি পরায়ন নেতাদের ক্ষমতার অন্ধ লোভ ও সম্পদ শুষে নেয়ার বাসনা দেশটিকে বারংবার রণক্ষেত্রে পরিণত করেছে। বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাস গোষ্ঠীগুলোও দেশটির অভ্যন্তরীণ অরাজকতার সুযোগ নিয়ে অনুপ্রবেশের সুযোগ পেয়েছে। হীরা, স্বর্ণ, ইউরেনিয়ামের মত মুল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ হাতিয়ে নেবার লোভে নানান শক্তিশালী দেশের হস্তক্ষেপ দেশটির সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট করেছে বারবার। অবিরাম যুদ্ধ বিগ্রহ চলার ফলে দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে। উপরন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার যাচ্ছেতাই অবস্থার কারণে রাজধানী বাঙ্গুই এর বাইরে বেশির ভাগ অঞ্চলেই সরকারী নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা সম্ভব হয় নি। সরকার দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাই সাধারণ নাগরিকদের সাথে অহরহ ঘটে অপহরণ, ধর্ষণ, ডাকাতি, খুনের মত জঘন্য অপরাধ। জীবনের নিরাপত্তার সন্ধানে দেশটির বেশির ভাগ জনগণ তাই বাস্তু ছাড়া। UN Migration er IOM এর তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের প্রায় ৭ লাখ ৮৭ হাজার ৭৩৮ জন বিভিন্ন দেশের শরণার্থী শিবিরে আছে যা দেশটির জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ। অভ্যন্তরীণ গৃহহীন হয়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার ৬৭৩ জন মানুষ।
বাসস্থানের অভাব, খাদ্য, নিরাপদ পানি, শৌচালয়, রাস্তা, শিক্ষা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত মধ্য আফ্রিকার দেশটির মানুষ প্রতিনিয়ত মানবেতর জীবন যাপন করে।জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রতি বছর বড় অংকের সাহায্য আসে এ দেশে। বিভিন্ন দেশের সেচ্ছাসেবকরা দেশটির দরিদ্র, অসহায় মানুষের পাশে দাড়াতে এগিয়ে আসে। কিন্তু মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র সেচ্ছাসেবকদের জন্য এক বিভীষিকাময় জায়গা। ২০২১ সালে অন্তত ১৫ জন সাধারণ জনগণ বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলায় নিহত হয়। ২০২৩ এ ৯ জন চাইনিজ খনি শ্রমিককে মেরে ফেলা হয়। ধারণা করা হয় রাশিয়ান প্যারামিলিটারি বাহিনী তাদের উপর আক্রমণ করে। রাশিয়ান প্যারামিলিটারিকে দেশটির বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তার স্বার্থে আনা হলেও বর্তমানে তারা নিজেরাই বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছে। খনির নিয়ন্ত্রণ পাবার জন্য ও অঞ্চলে প্রভাব বজায় রাখতে হেন অপকর্ম নেই যে তারা করে না। অপরদিকে স্থানীয় সন্ত্রাস বাহিনী বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করার থেকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ে বেশি আগ্রহী থাকে।ইউএন এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২৪ সালে ২৮ লক্ষ মানুষের মানবিক সাহায্য ও নিরাপত্তার প্রয়োজন ছিল। ২০২৪ সালে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র দেশটির সাহায্যের জন্য UNHCR এর মোট ২৪৬.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্যের প্রয়োজন ছিল, যেখানে সংস্থাটি শুধুমাত্র এর ৩০ ভাগ পেয়েছে। এর মধ্যে আমেরিকার অনুদান সবচেয়ে বেশি ১৬১.৭ মিলিয়ন।
দেশটির অনেক অঞ্চলে চিকিৎসা ব্যবস্থাই নেই। বিভিন্ন শান্তি রক্ষী বাহিনীরা প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা সুবিধা দিচ্ছে। মহামারী ও চিকিৎসার অভাবে হাজারো মানুষ প্রতিনিয়ত মারা যায়। সন্তান জন্মদানের সময়ে প্রতি ১০০০ জনে ১১৬ জন মা মারা যান যার জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ভংগুর অবস্থা দায়ী।
বিভিন্ন মুল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের খনি থাকায় দেশটিতে খনিগুলোকে ঘিরে চোরাচালান ও অস্থিরতা বিদ্যমান থাকে প্রায়শই। বহু আগ থেকেই অর্থনৈতিক ভাবে দেশটি বিপর্যস্ত দেশটি ২০২৩ সালে আরও অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া শুরু করল। এর পেছনের সবচেয়ে বড় কারণ হল জ্বালানি সংকট। দেশটিতে জ্বালানি পর্যাপ্ত না থাকায় অন্য দেশ থেকে জ্বালানি রপ্তানি করার প্রয়োজন হয়। এই রপ্তানিকৃত জ্বালানি দেশটিতে মূলত নদী পথে প্রবেশ করে। মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে পর্যাপ্ত রাস্তা ও রেলপথ না থাকায় এর যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভংগুর। তাই এর রপ্তানিকৃত পণ্য প্রতিবেশী যে দেশগুলোতে পোর্ট আছে সে দেশগুলোতে আসে। সাধারণত আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে সীমান্তবর্তী ক্যামেরুনের পোর্ট ডোয়ালাতে রপ্তানির পণ্য গুলো রাখা হয়৷ অতপর উবাঙ্গুই নদী যা মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র এর মধ্যে দিয়ে বহমান ও দেশটির উত্তরদিকের সীমান্তে অবস্থিত, সে নদীর মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশের পোর্ট থেকে মালামাল ও জ্বালানি দেশটিতে প্রবেশ করে। বর্তমানে দেশটিতে প্রচন্ড জ্বালানি সংকট বিদ্যমান। যার অন্যতম কারণ নদী পথের সরবরাহ কার্যক্রম ঘিরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও অনিশ্চয়তা। যার ফলে অধিকাংশ ব্যবসা বাণিজ্য ও কারখানায় উৎপাদনের মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেশির ভাগ অঞ্চলে প্রায়ই বিদুৎ থাকে না। এছাড়াও ২০২৪ সালের শুরুতে বিভিন্ন খনি অবস্থিত জায়গায় চোরাচালান ও অন্তর্কোন্দলের কারণে স্বর্ণের উৎপাদন ১৩% কমে যায় যা অর্থনৈতিক ব্যাপক ধস নামায়।
ইতিহাস
দেশটির এমন দুরবস্থার কারণ বুঝতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে এর জন্মলগ্নে।
হীরা, স্বর্ণ, লৌহ, ইউরেনিয়াম, তামা, ম্যাঙ্গানিজ এর মত প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীর অন্যতম গরীব দেশ মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র। ১৩ অগাস্ট, ১৯৬০ সালে ফ্রান্স থেকে স্বাধীন হয়ে নতুন দেশের পরিচয় পাওয়া মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র স্বাধীন হলেও, তার স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারে নি। ফ্রান্স থেকে আলাদা হবার পর দুর্বল প্রশাসন, ভঙ্গুর রাষ্ট্রব্যবস্থা, একের পর এক বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিদ্রোহ, হানাহানি দেশটির অভ্যন্তরে জলজ্যান্ত যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করে। ১৯৬০ সালে ফ্রান্স থেকে স্বাধীন হয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট ডেভিড ড্যাকো, উবাঙ্গি শারী দেশের নতুন নাম রাখেন মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র। ড্যাকো নতুন সৃষ্ট দেশের সহযোগিতার জন্য ফ্রান্সের সামরিক বাহিনী, বৈদেশিক সম্পর্ক, ব্যবসা বাণিজ্যে ফ্রান্সের সহযোগিতা নেয়। কিন্তু দেশের বিভিন্ন বিদ্রোহ থামাতে ব্যর্থ ড্যাকো দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও নিয়ে আসে। নানা রকম অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি দেশটির ঋণের বোঝা ভয়ংকরভাবে বাড়িয়ে তোলে। দেশ যখন দেউলিয়া হবার প্রান্তে তখন সামরিক ক্যু করে আর্মি কমান্ডার জ্যঁ-বিডেল বোকাসা ক্ষমতার দখল নেন। বোকাসা এসে সব সংবিধান বাতিল করে দেয় এবং নিজেকে আজীবনের জন্য সরকার ঘোষণা করে। ফ্রান্স চাচ্ছিল দেশটির হীরার খনিগুলির নিয়ন্ত্রণ নিতে তাই ফ্রান্স বোকাসার সমস্ত অসাংবিধানিক কাজকে সমর্থন দেয়। ১৯৭৬ সালে বোকাসা নিজেকে দেশটির রাজা ঘোষণা দেয় এবং সেই বছরই বিশাল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজমুকুট পড়ে যা ফ্রান্সের দ্বারা আয়োজিত ছিল। বোকাসা যখন নিজেকে অপ্রতিরোধ্য ভাবছিল ঠিক তখনই তার পতনের শুরু হল। হীরার খনি গুলো বোকাসা নিজে নিয়ন্ত্রণ করত এবং এর থেকে হওয়া খনি বানিজ্যের লভ্যাংশের বেশির ভাগ অংশই নিজের কাছে রেখে দিত যার ফলে ফ্রান্স অসন্তুষ্ট হয়। ১৯৭৯ সালে ফ্রান্স সামরিক ক্যু এর মাধ্যমে বোকাসাকে সরিয়ে আবার ডেভিড ড্যাকোকে ক্ষমতায় ফেরত আনে। ড্যাকোর পর একে একে ক্ষমতায় আসে জেনারেল আন্দ্রে কোলিংবা, অ্যাঞ্জে-ফেলিক্স প্যাটাসে, ফ্রাঁসোয়া বোজিজ।
২০০৩ সালে ফ্রাঁসোয়া বোজিজ ক্ষমতায় আসে। নানান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যেও ফ্রাঁসোয়া বোজিজ টিকে থাকে। ২০০৭ এবং ২০০৮ সালের দেশের পরিস্থিতি আবার চরম অশান্ত হয়ে উঠলে পরিস্থিতি শান্ত করতে সরকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে একটি সমাধানে আসে। পরবর্তীতে বোজিজ সরকার চুক্তির অবমুল্যায়ন করলে, ২০১২ সালে ছোট ছোট বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী নিয়ে একটি বড় দল ‘সেলেকা’ গঠিত হয়। সাঙ্গু ভাষা অনুযায়ী সেলেকা অর্থ সম্পর্ক। মূলত এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি মুসলিম যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত। সরকার দেশের মুসলিমদের ব্যাপারে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয় ও চুক্তি ভঙ্গ করে যাতে তারা অসন্তুষ্ট ছিল। এ অসন্তোষ থেকেই সেলেকার গোড়াপত্তন। সেলেকা দেশটির প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া বোজিজের পদত্যাগ দাবি করে। বোজিজে এ অসন্তোষ থামানোর জন্য প্রথমে সেলেকা গোষ্ঠীর সাথে শান্তিচুক্তি করলেও ধীরে ধীরে বিভিন্ন অসন্তোষে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।২০১৩ সালের মার্চ মাসে তারা সদল বলে রাজধানী বাঙ্গুইয়ে হামলা করে দখলে নিয়ে নেয়, এর মধ্যেই প্রেসিডেন্ট বোজিজ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।
বোজিজ পালিয়ে গেলে সেলেকার প্রধান মিশেল জোটোদিয়া নিজেকে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করে। কিন্তু তার এ ঘোষণাকে বিভিন্ন প্রতিপক্ষ ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের অর্থনৈতিক সংগঠন প্রত্যাখ্যান করে। তারা অন্তর্বতীকালীন সরকার দাবি করে, যার নিয়ন্ত্রণে স্বচ্ছ নির্বাচন সংগঠিত হবে। জোটোদিয়া ECCAS এর প্রস্তাব মেনে নিয়ে একটি অন্তর্বতীকালীন কাউন্সিল গঠন করে এবং সে কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়। এদিকে সেলেকা গ্রুপের নিজেদের মধ্যে যথাযথ ঐক্য না থাকায় তারা অন্তর্কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। সারাদেশে সন্ত্রাসবাদ, লুটপাট, ধর্ষণ, ধ্বংসযজ্ঞ চালায় দলটি। সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ জোটোদিয়া সেলেকা গ্রুপটি ভেঙে দেন কিন্তু তাতেও তাদের সন্ত্রাসবাদ থামানো যাচ্ছিল না। এরই মধ্যে অনেক সংখ্যক খ্রিস্টানরা মিলে আত্মরক্ষার জন্য ‘ এন্টি বালাকা’ নামক একটি দল গড়ে তোলে। শুরু হয় দেশটির বিভিন্ন অংশে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের গোষ্ঠীর ভেতর দাঙ্গা। দুইপক্ষের তুমুল দাঙ্গা শেষমেশ গৃহযুদ্ধে গড়ায়। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক, প্রাদেশিক বিভিন্ন নেতাদের চাপ প্রয়োগের ফলে জোটোদিয়া পদত্যাগ করে। এ যুদ্ধ, দাঙ্গা, সন্ত্রাসবাদ বন্ধের জন্য আফ্রিকান ইউনিয়ন এর সেনা সদস্য, ২০০০ ফ্রেঞ্চ সৈনিক দেশটিতে প্রবেশ করে। তাদের লক্ষ ছিল দেশের অস্থিতিশীল পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে এনে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে দেশটির একজন শাসক নির্ধারণ করা। ২ বছর পর ফেব্রুয়ারির ২০১৬ সালে অবশেষে দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৬২% এর বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হন বোজিজের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ফস্টিন-আর্চেঞ্জ তোয়াদেরা। নব্যনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এলেও দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় নি। নির্বাচনের পর ফ্রান্স ও ইউএন তাদের সৈন্য সরিয়ে নেয়। তবে আমেরিকা, ফ্রান্স ও পশ্চিমা বিশ্ব থেকে মানবিক সাহায্য আসা জারি ছিল।
রাশিয়ার অনুপ্রবেশ
২০১৭ সালে তোয়াদেরা নিজের পদ বজায় রাখতে ও নিরাপত্তার স্বার্থে রাশিয়া ভাড়াটে প্যারামিলিটারি বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপ ও রেয়ান্ডার বেসামরিক সৈন্যদের নিরাপত্তায় সহায়তার জন্য দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়। ২০২১ সালে বাঙ্গুইতে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আক্রমণের সময় রাশিয়া ও রেয়ান্ডার বাহিনী সরকারকে সাহায্য করে যা সরকারকে তাদের প্রতি আরও নির্ভরশীল করে তোলে।
রাশিয়ার এই প্যারামিলিটারি সংস্থার একটি অংশ ওয়াগনার গ্রুপ ২০১৭ সাল থেকেই মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে সক্রিয়। দেশটির উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা প্রদান, মিলিটারি বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা প্রদান, বিদ্রোহী গোষ্ঠী দমন সহ আরও নানা রকম সুবিধা দিয়ে আসছে রাশিয়ার এই সংস্থাটি। এর পরিবর্তে দেশটির হীরা ও সোনার খনির মত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে রাশিয়া। মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নজর রয়েছে আরও অনেক দেশেরই। এর নিয়ন্ত্রণ পেতে মরিয়া অনেক দেশই। তাই রাশিয়ার দেশটিতে প্রবেশ করে প্রাকৃতিক সম্পদের খনির স্থানে প্রবেশাধিকার ও নিয়ন্ত্রণ ফ্রান্স, ইউএন সংস্থার কেউই ভালোভাবে নেয় নি।মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ত্রানের টাকায় রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করে এই সন্দেহে তারা মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দেয় যা কিনা দেশটির বাৎসরিক অর্ধেক ব্যয়ের সমান। রাশিয়ার প্যারামিলিটারি বাহিনী দেশটির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নিয়ন্ত্রণ পাবার পাশাপাশি দেশটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে প্রভাব রাখতে শুরু করে।রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করে রাশিয়া দেশটির স্বর্ণ, হীরার খনির মত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে ফেলে এবং এসব প্রাকৃতিক সম্পদ চোরাচালানে ও ব্যবসায়িক লেনদেনে অংশ নেয়। ২০২০ সালে আবারও নির্বাচনের মাধ্যমে তোয়াদেরা ক্ষমতায় আসে। নির্বাচন নিয়ে প্রতিপক্ষের তীব্র অসন্তোষ থাকলেও তা তোয়াদেরার মাথা ব্যাথা ছিল না৷ নির্বাচনের পর প্রতিপক্ষকে অন্যায় ভাবে ধর পাকড় করে, মিথ্যা অভিযোগে পাকড়াও করে জেলে ঢোকানো হয়। তোয়াদেরা ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে সাংবিধানিক এমন পরিবর্তন করে যা তাকে চিরকাল রাষ্ট্রপতির পদে বহাল থাকবে। রাশিয়ার প্রভাব থেকে দেশটিকে সরিয়ে আনতে ফ্রান্স ও ইউএন দেশটির সরকারকে সাহায্যের মাধ্যমে প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করে। আমেরিকা দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় যা বর্তমানে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রনাধীন। কিন্তু আমেরিকার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার খবর পৌঁছাতেই দেশটিতে রাশিয়ান বাহিনীর দ্বারা বিভিন্ন কুৎসা রটে যায় আমেরিকা নিয়ে। ফলে আমেরিকার বেশ কিছু নাগরিককে নিরাপত্তার স্বার্থে ২০২৩ এর অক্টোবর থেকে ২০২৪ এর জানুয়ারীর মধ্যে দেশটি থেকে স্থানান্তর করা হয়।
ভূগোল ও পরিচিতি
আফ্রিকা মহাদেশের একদম মাঝে অবস্থিত এই দেশটির আয়তন ৬ লাখ তেইশ হাজার বর্গ কিলোমিটার। চাদ, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, সুদান, দক্ষিণ সুদান, গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র ও ক্যামেরুন এই ৬ টি দেশ দ্বারা বেষ্টিত এই দেশের মানুষের প্রধান ভাষা হল সাঙ্গো। দেশের দক্ষিণাংশে উবাঙ্গী নদীর তীরে অবস্থিত দেশটির রাজধানী বাঙ্গুই। ২০২১ সালে জরিপ অনুযায়ী দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ৬১ লক্ষ। এর মধ্যে জনসংখ্যার প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ দরিদ্র। হিউম্যান ক্যাপিটাল ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সের পরিসংখ্যান অনুসারে বিশ্বের ১৯৩ টি দেশের মধ্যে এ দেশটির অবস্থান ১৯১ তম। দেশটিতে পেট্রোলিয়াম, স্বর্ণ, হীরা, ইউরেনিয়াম সহ আরও বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের প্রায় ৪৭০ টি খনি রয়েছে। ডিসেম্বর ২০২২ এর তথ্য মতে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের মোট স্বর্ণ উৎপাদন ছিল ১০০০ কেজি। ১৯৯০ এর ডিসেম্বর থেকে ২০২২ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত গড় উত্তোলন ছিল ৬০ কেজি।
২০২২ সালে প্রায় ৩৫.৭ মিলিয়ন ডলারের হীরা রপ্তানি করে দেশটি, যা হীরা রপ্তানিকারক দেশগুলির মধ্যে ৪০ তম।
শেষকথা
স্বাধীনতার পর থেকেই নানান গোষ্ঠীর নিজস্ব স্বার্থ সিদ্ধির চক্রে পড়ে সৃষ্ট লাগাতার গৃহযুদ্ধ ও সরকারের চরম অব্যবস্থাপনা এবং জনগণের প্রতি দ্বায়িত্বহীনতা আজ দেশটিকে বিশ্বের মঞ্চে এক চরম ব্যর্থ দেশে পরিণত করেছে। নিজস্ব যথেষ্ট সম্পদ ও বহির্বিশ্ব থেকে প্রতি বছর অনুদান পাওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত দেশটি নিজেদের জনগণের মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা দানে প্রবলভাবে ব্যর্থ। তাই পুরো বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মাঝে অন্যতম ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা আজ মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের।