ছোট্ট এ জীবনে উন্নত জীবনযাপনের অভিলাষ কার না রয়েছে। নিজের জন্য, নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে মানুষ দারিদ্র্য কাটিয়ে উঠে আর্থিক ভাবে স্বচ্ছলতা পাবার কতই না কসরত। এই তীব্র অভিলাষই দারিদ্র প্রধান দেশের মানুষকে পৃথিবীর সবচাইতে দুর্গম, ভয়ংকর, গহীন জংগল পাড়ি দিয়ে উন্নত দেশে অবৈধ ভাবে নিজের একটু জায়গা করে নেয়ার স্বপ্নের সৃষ্টি করে। আজ বলব এমনই এক অবৈধ ভয়ানক পথের কথা যে দুর্গম পথ পার করে আমেরিকার মত উন্নত দেশে গিয়ে নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নের আশায় মানুষ নিজের জীবনের পরোয়া পর্যন্ত করে না। ১৬০ কি.মি. জুড়ে বিস্তৃত গহীন ঘন সবুজ জঙ্গল যা ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কলম্বিয়া ও পানামার ঠিক মধ্যখানে, তার নাম ড্যারিয়ান গ্যাপ। ১০,০০০ স্কয়ার কি.মি. বিস্তৃত আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম জংগল এ ড্যারিয়ান গ্যাপ কলম্বিয়ার উত্তরাংশ ও পানামার দক্ষিণাংশের প্রদেশ জুড়ে রয়েছে। রাস্তা বিহীন, নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা ছাড়া গহীন এ বন পেরোনো বহু বছর ধরে অসম্ভব ছিল। আলাস্কা থেকে আর্জেন্টিনা পর্যন্ত দীর্ঘ প্যান আমেরিকান রাস্তার একমাত্র বাধা এই ড্যারিয়ান গ্যাপ। যার ফলে আজও উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা স্থল পথে সরাসরি যুক্ত হতে পারে নি।
এ বনে নেই কোনো রাস্তা, মোবাইল নেটওয়ার্ক। পাহাড়, খাল, খন্দক, বিরুপ আবহাওয়ার কারণে এখানে মানুষের বসবাসও খুবই নগন্য। গহীন জংগল ও যোগাযোগ ব্যাবস্থা খুবই দুর্বল হওয়ার ফলে ছোট ছোট অনেক চোরাচালান এই জঙ্গলে ব্যাপক সক্রিয়।
দুর্গম এ মৃত্যুপুরী পেরোতে তাও মরণ চেষ্টা করে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ। পানামার ভয়ংকর এ জংগল পাড়ি দেয়া নতুন কোনো ঘটনা না। ২০১০ সাল থেকেই পানামার প্রশাসন ড্যারিয়ান গ্যাপে কিছু অভিবাসীদের উপস্থিতি আঁচ করতে পারে। সেই সময় থেকে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত এ পথ পাড়ি দেয়ার অভিবাসীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কয়েক লাখ মানুষে। কিন্তু কেন জীবনের প্রচন্ড ঝুঁকি নিয়ে এত মানুষ পাড়ি দেয় এই পথ?
উন্নত দেশ এবং অর্থনৈতিকভাবে শোচনীয় দেশের মানুষের জীবনযাত্রার বিস্তৃণ ফারাক মানুষকে নিজের জন্মভূমি ছেড়ে দূর দেশে পাড়ি জমানোর আগ্রহ জাগায়। উত্তর আমেরিকা অর্থনৈতিক ভাবে অনেক স্বচ্ছল। সেখানকার মানুষের জীবনের নিরাপত্তা রয়েছে, রয়েছে উন্নত জীবন যাপনের সুযোগ। অপর দিকে ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যায় দক্ষিণ আমেরিকায়। অর্থনৈতিকভাবে জর্জরিত এসব দেশের মানুষের জীবনের, কর্মসংস্থানের কোনো নিরাপত্তা নেই, দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে এখানকার অসংখ্য মানুষ। জীবনের একটু পরিবর্তনের আশায়, উন্নত জীবনের খোঁজে দক্ষিণ আমেরিকার অনেক মানুষ তাই অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছলতার আশায় উত্তর আমেরিকায় যাওয়ার প্রচেষ্টা করে৷ পর্যাপ্ত যোগ্যতা না থাকায় অধিকাংশ মানুষ বেছে নেয় অবৈধ পথ যা এতটাই দুর্গম যে যার মাশুল অনেক মানুষকে নিজের জীবন দিয়ে দিতে হয়। তবে শুধু দক্ষিণ আমেরিকার মানুষই নয়, সারা বিশ্বের নানান দেশের মানুষ এই পথ পাড়ি দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে তাদের স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়।
নিরক্ষরেখা থেকে মাত্র ৮০০ কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত হওয়ায় ড্যারিয়ান গ্যাপে সারাবছর প্রচন্ড গরম থাকে। এর এক পাশে প্রশান্ত মহাসাগর ও অপর পাশে আটলান্টিক মহাসাগর রয়েছে। দুই মহাসাগর থেকে প্রচুর জলীয়বাস্প ড্যারিয়ান গ্যাপে প্রবাহিত হয় ফলে আবহাওয়ায় উষ্ণতা আরো বেড়ে যায়। এলাকাটি রেইনফরেস্টের মাঝে পড়ায় সারাবছর জুড়েই বৃষ্টিপাত হয়। বছরে গড়ে প্রায় ৫২০০ মি.লি. পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়। অতিবৃষ্টির কারণে পাহাড়ি ঢালে ধস নামে, আবার হঠাৎ এখানের নদীগুলোতে বন্যার সৃষ্টি হয়ে অভিবাসীদের তাবু, থাকার জায়গা, মানুষ পর্যন্ত ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাছাড়া পাহাড়ি উঁচু নিচু, এবড়োথেবড়ো পথ মানুষের চলাচলকে আরো কঠিন করে তোলে।
ড্যারিয়ান গ্যাপকে ভয়ংকর করে তোলে আরেকটি ব্যাপার। ড্যারিয়ান গ্যাপ পৃথিবীর অনেক বিষাক্ত প্রাণির আবাসস্থলও বটে। ড্যারিয়ান গ্যাপই খুব সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র জায়গা যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিষাধর সাপ বুশমাস্টার পাওয়া যায়। এ জায়গা এক প্রজাতির বিষাক্ত ব্যাঙ এর আবাসস্থল, যার ছুড়ে দেয়া বিষে কয়েক ঘন্টার ভেতর মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এছাড়াও মাকড়সা, কীটপতঙ্গ ও প্রচুর মশা রয়েছে। যাদের কামড়ে অসংখ্য মানুষ অসুস্থ হয়ে মৃত্যু বরণ করে।
কেনো স্থলপথে যুক্ত না দুই আমেরিকা
ভীষণ প্রতিকূল পরিবেশে, দুর্গম জংগলে যে কোন স্থাপনা নির্মাণের কাজ খুবই কঠিন ও ব্যয়বহুল। তবে যেখানে পাথর কেটে বাড়ি বানানো মানুষ জাতির জন্য নিশ্চয়ই দুর্গম পরিবেশেও রাস্তা বানানো অসম্ভব কিছু নয়। তবে কেন এতদিনেও কোনো রাস্তা নির্মাণ হয় নি? উত্তরটি বেশ জটিল। ভূ-রাজনীতি এর পেছনের সবচেয়ে বড় কারণ। ১৯৩৬ সালে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাকে সংযুক্ত করার উদ্দেশ্যে আলাস্কার প্রুডোবে থেকে আর্জেন্টিনা পর্যন্ত প্যান আমেরিকান রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। পরবর্তী প্রায় ৩০ বছর ধরে ৩০,০০০ কি.মি. দীর্ঘ রাস্তা নির্মিত হয়। শুধুমাত্র ড্যারিয়ান গ্যাপের অংশটুকুতে কোনো রাস্তা নির্মাণ হয় নি। আসুন জানি এর পেছনের জিও পলিটিক্স। ১৮৯০ সালে পানামা ছিল কলম্বিয়ার একটি অংশ। তবে ড্যারিয়ান গ্যাপের জন্য পানামা আর কলম্বিয়ার মাঝে কোনো স্থলপথে সংযোগ ছিল না। ফলে পানামা নিয়ন্ত্রণ করা কলম্বিয়ার পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকতে থাকতে পানামায় এক সময়ে আলাদা স্বতন্ত্র দেশ ও স্বাধীনতার দাবি ওঠে। পানামার এই দাবিকে উসকে দেয় আমেরিকা। পানামা ছিল আমেরিকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পানামায় ১৮৮১ সালে ফ্রান্স কর্তৃক পানামা খাল নির্মাণ হতে গিয়ে অর্থের অভাবে ১৮৯০ সালে আবার বন্ধ হয়ে যায়। এই খাল নির্মাণ আমেরিকার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি যাতায়াত ব্যবস্থা।কারণ আমেরিকার পূর্ব উপকূল থেকে পশ্চিম উপকূলে কোনো জাহাজকে আসতে হলে সম্পূর্ণ দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরে আসতে হত। এতে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য করতে সমস্যা হচ্ছিল। এমনকি ভবিষ্যতে কোনো যুদ্ধ হলেও সেখানে নেভি ফোর্স পাঠানো হত সময় সাপেক্ষ। কিন্তু পানামা যদি কলম্বিয়ার অধীনে থাকে তবে এই পানামা খাল নির্মাণ হয়ে গেলে তা আমেরিকাকে ব্যবহার করতে নাও দিতে পারে। তাই আমেরিকা পানামা খালের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য পানামাকে একটি স্বতন্ত্র দেশ হতে সাহায্য করে।
পানামার স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় কলম্বিয়া স্থলপথে কোনো আর্মি পাঠাতে পারছিল না কারণ পানামা আর কলম্বিয়ার মাঝে রয়েছে ড্যারিয়ান গ্যাপ, যা পার হওয়া ছিল খুবই কঠিন। তখন কলম্বিয়ার সরকার পানিপথে তাদের নেভিফোর্স পাঠায়। এ অবস্থায় আমেরিকা তাদের নেভীফোর্স পাঠিয়ে পানামাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে কলম্বিয়ার আক্রমণ থেকে প্রোটেক্ট করার জন্য। ফলে কলম্বিয়া পানামার নিয়ন্ত্রণ হারায়। কারণ কলম্বিয়াও আমেরিকার মত শক্তিশালী দেশের সাথে পাঙ্গা নিতে চায় নি। পরবর্তীতে ১৯০৩ সালে পানামা নিজেকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। তাদেরকে স্বাধীন দেশ হিসেবে সবার প্রথম স্বীকৃতি দেয় স্বাভাবিক ভাবেই আমেরিকা। যেহেতু পানামাকে স্বাধীন করতে আমেরিকা সাহায্য করে এর বিনিময়ে পানামার সাথে আমেরিকার পানামা খাল নিয়ে একটি চুক্তি হয় এবং পানামা খাল আমেরিকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। ড্যারিয়ান গ্যাপে রাস্তা না থাকায় পানামা এবং আমেরিকা দুই দেশই এর ফায়দা উঠাতে পেরেছিল। তাই এই দুই দেশই আর চায় নি প্যান আমেরিকান রাস্তার মাধ্যমে পানামা আর কলম্বিয়া যুক্ত হোক নয়তো পানামার স্বাধীনতা ঝুঁকির মধ্যে পড়ত।
তবে এই কারণ ছাড়াও আরো একটি কারণ আছে রাস্তা না করতে চাওয়ার। কলম্বিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কোকেন উৎপাদনকারী দেশ। বিশ্বের প্রায় ৬০% কোকেন এ দেশে উৎপাদিত হয়। এই ড্রাগ বেশির ভাগ পাচার হয় উত্তর আমেরিকায়। মারাত্মক ক্ষতিকর ড্রাগ কোকেন আমেরিকায় বন্ধ করার জন্য আমেরিকার সরকার বহু বছর ধরে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছে। এর মধ্যেও বিভিন্নভাবে কলম্বিয়া থেকে আমেরিকায় ড্রাগ পৌঁছে যায়। তবে সরাসরি রাস্তা না থাকায় ড্রাগ মাফিয়াদের জন্য কোকেন পাচার করাটা কঠিন। ড্যারিয়ান গ্যাপে রাস্তা হয়ে গেলে পানামা এবং আমেরিকা দুই দেশের জন্যই ড্রাগ পাচার রোধ করা আরো কঠিন হয়ে যেত।
এছাড়াও প্রতি বছর অনুন্নত দেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ আমেরিকায় অবৈধভাবে পাড়ি জমাতে চায় উন্নত জীবিকার জন্য। এদের মাঝে দক্ষিণ আমেরিকার মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অর্থনৈতিক ভাবে বিদ্ধস্ত দেশের মানুষ জীবনের অবস্থা পরিবর্তনের আশায় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পার হয় ড্যারিয়ান গ্যাপ। এদের কেউ সফল হয়, কেউ বা ব্যর্থ আবার কেউ বা নিকৃষ্টভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নেয়। ড্যারিয়ান গ্যাপে রাস্তা হলে অবৈধ অভিবাসীদের ঠেকানো খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।