পড়ার টেবিলে বসে ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছেন। একটু পরেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কফি প্রয়োজন। কিচেন থেকে কফি আনতে খুবই আলসেমি লাগছে। কতই না চমৎকার হত যদি চিন্তা করা মাত্রই নিজ থেকে কফির মগটি উড়ে আপনার কাছে চলে আসত? মানে যাওয়া লাগল না, ধরা লাগল না জাস্ট চিন্তা করতেই কফির মগটি বাতাসে ভাসতে ভাসতে চলে আসল।
কি ভাবছেন? এটাতো খুবই চেনা গল্প? টিভি শো আর সিনেমায় তো অহরহই দেখি এই জাদুকরী শক্তি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই অদ্ভুত ব্যাপার স্যাপার নিয়ে আলোচনা চলেছে বিজ্ঞানেও। আজ আমরা জানব জাদুকরী এই শক্তি সম্পর্কে যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় টেলিসাইকোসিস বা সাইকোসাইসিস।
ডক্টর স্ট্রেইঞ্জ গভীর ফোকাস করে একটি চক্র তৈরি করে, তার মাধ্যমে এক ডাইমেনশন থেকে আরেক ডাইমেনশন, এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যায়। বা স্ট্রেইঞ্জার মুভির ইলেভেন যখন শুধু মাত্র চোখের ইশারায় তীব্র ফোকাস দ্বারা কোনো জিনিসকে বাকা করে দেয়। অথবা ম্যাট্রিকস মুভিতে দূর থেকে বুলেট থামিয়ে দেয়া। সিনেমাগুলোতে এই পাওয়ার দেখানোর থিওরিটা কোত্থেকে এলো ভেবে দেখেছেন কি কখনো? এই শক্তির নাম দেয়া হয় টেলিকাইনোসিস। বিজ্ঞানীরা একে বিজ্ঞানের অংশ মানতে নারাজ। তাদের কাছে এগুলো নিছকই কল্পনাপ্রসূত। কিন্তু সত্যটা কি? আপনি কি টেবিলে বসে থেকে কিচেন থেকে আপনার কফি সত্যিই উড়িয়ে নিয়ে আসতে পারবেন?
টেলিকাইনেসিস দুটি গ্রিক শব্দ, ‘টেলি’ ও ‘কাইনেসিস’ নিয়ে এ শব্দটি গঠিত। টেলি মানে দূরবর্তী, আর কাইনেসিস মানে নড়াচড়া। অর্থাৎ কোনো প্রকার স্পর্শ করা ছাড়াই শুধুমাত্র মস্তিষ্কের তৈরি শক্তির ওয়েভের মাধ্যমে কোনো বস্তুকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরানোকে টেলিকাইনোসিস বলা হয়। Telekinesis শব্দটা প্রথম ব্যাবহার করা হয় ১৮৯০ সালে। Alexander N. Aksakof নামক একজন বিজ্ঞানি প্রথম এই ধারনা প্রচার করে। ধরুন সিনেমাতে যেমন আমরা দেখি কোনো সুপারহিরো দূর থেকে শুধুমাত্র হাতের ইশারাতেই ভিলেনকে ছুড়ে দূরে ফেলে দিল বা শুন্যে ভাসিয়ে ফেলল, এই ক্ষমতাই মূলত টেলিকাইনোসিস বা সাইকোকাইনোসিস। শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন রাশিয়ান লেখক ও মনস্তাত্ত্বিক গবেষক আলেকজান্দার অ্যাক্সাকভ (Alexandar Aksakov)।
এখন প্রশ্ন হল সিনেমাতে তো অতিপ্রাকৃত কত কিছুই দেখে থাকি আমরা৷ কিন্তু আদো কি এই ক্ষমতার কোনো সত্যতা আছে? এটা কি সত্যিকার দুনিয়ায় সম্ভব? টেলিকাইনোসিস বা সাইকোকাইনোসিসের পেছনের লজিক হল এটি ব্রেইনের পাওয়ারের সাহায্যে করা হয়। চলুন তাহলে প্রথমে জানি আমাদের ব্রেইনের পাওয়ার আসলে কতটুকু?
সিনেমাতে দেখানো টেলিকাইনোসিস পাওয়ার দেখানোর পেছনে লজিক থাকে মানুষের ব্রেইনের ওয়েভ। তারা দেখায় মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ ফোকাস একত্রিত করতে পারলে ব্রেইনে তৈরি হওয়া তরঙ্গের মাধ্যমে দূর থেকেই কোনও বস্তু নিয়ন্ত্রণ বা বস্তুর অবস্থা পরিবর্তন করা সম্ভব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মস্তিষ্কের তরঙ্গ কোনো পদার্থের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে না। একটি মানুষের মস্তিষ্ক চিন্তা করার সময় তার নিজস্ব ব্রেনওয়েভ তৈরি করে। কেননা, এটি আমাদের মাথার খুলির বাইরের কোনো কিছুকে প্রভাবিত করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।আইজ্যাক নিউটনের গতির সূত্রানুসারে, বাইরে থেকে বল প্রয়োগ না করলে গতিশীল বস্তু সুষম গতিতে সরল পথে চলতে থাকে। আর স্থির বস্তু সবসময় স্থির থাকে। আর তাই বাহ্যিক কোনো বল প্রয়োগ ছাড়া কোনো বস্তুকে দূর থেকে নাড়ানো অসম্ভব। তবে কি একেবারেই নেই টেলিকাইনোসিস?
এক সময়ে আমরা জানতাম যে মানুষ তার ব্রেইনের পুরোটা ব্যবহার করতে পারে না। শুধুমাত্র ১০% ও যদি ব্যবহার করা সম্ভব হত তাহলে অতিপ্রাকৃত কার্যকলাপও সম্ভব হত। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা গেছে যে এতদিন আমাদের যে ধারণা ছিল তা সম্পূর্ণ ভুল! মানুষ তার মস্তিষ্কের পুরোটাই ব্যবহার করে। একই সময় পুরোটা ব্যাবহার না করলেও বিভিন্ন কাজে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ ব্যবহৃত হয়৷ তাই মস্তিষ্কের পুরোটা কাজে লাগিয়ে মানুষ কোনো অতিপ্রাকৃত কাজ করে ফেলবে সে আশায় গুড়ে বালি।
১৯ শ শতকের দিকে টেলিকাইনোসিস বা সাইকোকাইনোসিসের ধারণা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। প্রচুর ম্যাজিশিয়ান সে সময় টেলিকাইনোসিস বা সাইকোকাইনোসিসের মাধ্যমে তখন দূর থেকেই বস্তুকে শূন্যে ভাসানোর ম্যাজিক দেখানো শুরু করে। ১৯৭০ এর দিকে টেলিকাইনোসিস নিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা তখন বিজ্ঞানীদের মনেও নাড়া দেয়৷ প্রশ্ন ওঠে লেটস চেক দ্যা সাইন্স বিহাইন্ড দিস। বড় বড় সব ম্যাজিশিয়ানদের যখন নির্দিষ্ট পরিবেশে তাদের মস্তিষ্কের ফোকাসের জোরে কোনো বস্তুকে শুন্যে ভাসাতে বলা হয় বা দূর থেকে কোনো চামুচ বা লাঠি বাকাতে বলা হয় তখন তারা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়। তাদের সবার ব্যর্থতাই সব মিথের অবশান ঘটিয়ে প্রমাণ করে দেয় যে টেলিকাইনোসিস বস্তুত অসম্ভব৷
এখন আপনার যদি মনে হয় আপনি সাধনার মাধ্যমে টেলিকাইনোসিস করে দেখাতে পারবেন তাহলে কনগ্রেচুলেশন। আপনি হতে যাচ্ছেন ১ মিলিয়ন ডলারের মালিক। মানে বাংলাদেশের হিসেবে প্রায় ১২ কোটি টাকার মালিক হতে চলেছেন৷ জেমস রেন্ডি এডুকেশনাল ফাউন্ডেশন ঘোষণা দিয়েছে যে টেলিকাইনোসিস ক্ষমতার প্রমাণ দিতে পারবে তাকে ১ লক্ষ টাকা প্রদান করা হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত কেউই এই চ্যালেঞ্জ এ নিজেকে প্রমাণ করে টাকাটা জিতে নিতে পারে নি।
ফিজিক্সের সব সূত্রকে অস্বীকার করা টেলিকাইনোসিস থিওরি কি তবে আগাগোড়াই ধাপ্পাবাজি? নাকি সত্যতা থাকতেও পারে বলে আপনার বিশ্বাস? সত্যি বলতে যদিও বিজ্ঞান দিয়ে কখনো কেউ ব্যাপারটা প্রমাণ করতে পারে নি তবুও অনেক প্যারানরমাল সাইন্টিস্টের মতে এই শক্তির অস্তিত্ব আছে। এমনকি অনেক সাধারণ মানুষও এতে বিশ্বাস করে এখনও। কারণ বিজ্ঞান এখনো জ্ঞানের শীর্ষ সীমায় পৌঁছাতে পারে নি। অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে প্রকৃতিতে বিজ্ঞানে যা ব্যাখ্যাতীত। অনেক সাধু সন্ন্যাসী ধ্যানের মাধ্যমে শরীর ও মনের যোগসূত্রকে এত উন্নত করে যে সাধারণ মানুষের শারীরিক ব্যাথ্যা বেদনার অনুভূতি থেকে তাদের অনুভূতি হয় ব্যতিক্রম। বা কখনো দেখবেন অনেক দিন আগে যোগাযোগ হয়েছিল এমন কাউকে খুব মনে করছেন হঠাৎ ই মানুষটার কল চলে এল আপনার কাছে তারও আপনাকে হুট করেই মনে পড়ছিল। এমন কাকতালীয় মানসিক যোগাযোগের ঘটনা অহরহই শুনে থাকবেন। তবে কি আমাদের মানসিক শক্তির আসলেই কোনো সুপার পাওয়ার আছে? আসলেই কি সাধনার মাধ্যমে সম্ভব টেলিকাইনোসিস বা সাইকোকাইনোসিস? প্রশ্নটা থাকল আপনাদের জন্য।