ইলন মাস্কের স্টারশিপ- এই শতকের বিস্ময়

বন্ধের দিন ঘুরতে কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, রাঙামাটি না গিয়ে চাঁদে বা মঙ্গল গ্রহে গেলে কেমন হয় বলুন তো? এখন এমন আবদার আর নিছকই কোনো মশকারি নয়। খুব শীঘ্রই হয়ত আমরা দেখতে পাব মহাকাশ ভ্রমণের স্বপ্ন সত্যি হতে। আর এ স্বপ্ন দেখার সূচনা ইলন মাস্কের হাতে ধরে। 

ইলন মাস্কের স্পেসএক্স কোম্পানির মূল উদ্দেশ্য হল মহাকাশ প্রযুক্তিকে এমন উন্নত ও আধুনিকায়ন করা যেন এক সময় মানুষ অন্য গ্রহে বসবাস করতে পারে বা মহাকাশে ঘুরে বেড়াতে পারে। মহাকাশে যাওয়া যেন আরও সহজলভ্য হয় ও এর গবেষণা করতে যেন খরচ কমে আসে সে জন্য কাজ করছে এ কোম্পানি। সে লক্ষ্যে নিত্যনতুন উদ্ভাবন চলছে রকেট প্রযুক্তি। এর মধ্যে ইলন মাস্কের স্পেসএক্স থেকে সবচেয়ে বড় ইতিহাস গড়েছে ১৩ অক্টোবর ২০২৪ এ। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট স্টারশিপ উড্ডয়নের পর এর এক অংশ আবার সফল ভাবে অবতরণ করে। এ অভাবনীয় সাফল্য সুচনা করল মহাকাশ যাত্রার এক নতুন যুগের। 

রকেট প্রযুক্তির নতুন যুগ; Image Source: Pexels

স্টারশিপ

পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও বড় রকেট স্পেসএক্স এর বানানো এ স্টারশিপ। স্টারশিপ বানাতে এ পর্যন্ত ৪ বার বিভিন্ন পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ হয়েছে৷ প্রথম বার রকেট থেকে বুস্টার আলাদা হওয়ার আগেই রকেটটি ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে বিভিন্ন সংস্কার করার পরে এই প্রথম স্টারশিপ অভাবনীয় সফলতা পেল। তবে বুস্টারটিকে ফিরিয়ে আনা গেলেও মূল রকেট অর্থাৎ উপরের অংশ শিপকে এখনও অবতরন করানো সম্ভব হয় নি, ফলে এটি সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে।  প্রথম চারবার এর পরিক্ষামূলক উড্ডয়নের পর এর পঞ্চম উড্ডয়ন অক্টোবরের ১৩ তারিখে হয়। এটাই এ পর্যন্ত হওয়া সবথেকে সফল উড্ডয়ন। 

স্টারশিপের অংশ সমূহ

স্টারশিপের মূলত দুইটি অংশ। উপরের অংশকে বলা হয় শিপ এবং নিচের অংশকে বলা হয় বুস্টার। এ বুস্টারটির নামকরণ করা হয়েছে সুপার হেভি। সুপার হেভি বুস্টারের দৈর্ঘ্য আরো ১ মিটার বাড়ানোর ফলে বর্তমানে স্টারশিপের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১২০ মিটার।  উপরের অংশ শিপ এমনভাবে নির্মিত যাতে এটি ১০০ জন মানুষ বা ১০০ টনের বেশি জিনিসপত্র বহন করতে পারে। সুপার হেভি বুস্টারে রয়েছে ৩৩ টি ইঞ্জিন যা প্রায় ৭৪ মেগাটন ধাক্কার সৃষ্টি করে যার ফলে এটি নাসার আর্টেমিস রকেট থেকে দ্বিগুণ শক্তিশালী। এ সকল ইঞ্জিনে মিথালক্স নামক ফুয়েল ব্যাবহার করা হয়, যা মিথেন ও অক্সিজেনের মিশ্রণ।   স্টারশিপকে ধরে রাখার জন্য যে সুউচ্চ যন্ত্র বানানো হয়েছে তার নাম দেয়া হয়েছে মেকাজিলা। ছোটবেলায় গডজিলা কার্টুনের বিশালাকৃতির ড্রাগনের মতই এর নাম। এ মেকাজিলার গায়ে দুইটি হাতের আকৃতির যন্ত্র লাগানো হয়েছে যার মাধ্যমে মাঝ আকাশেই ল্যান্ডিং করতে থাকা বুস্টারটিকে ধরে ফেলা হয়। এ হাত আকৃতির যন্ত্রের নাম দেওয়া হয়েছে চপস্টিক। পঞ্চম পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণে শিপকে তার উৎক্ষেপনের জায়গায় ল্যান্ড করানো না গেলেও সফলভাবে বুস্টারকে ল্যান্ড করানো গেছে। যা ভবিষ্যতে শিপসহ বুস্টারকে নিরাপদে ল্যান্ড করানোর আশাকে অনেক গুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। 

স্টারশিপের বিভিন্ন অংশ

স্পেসএক্সের শুরু

২০০২ সালে স্পেসএক্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ২০০৬ সালে ফেলকন-১ উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে মহাকাশযান প্রযুক্তির বিপ্লবে এ প্রতিষ্ঠান নতুন সূচনা করে। মূল লক্ষ্য মঙ্গল গ্রহে বসবাস। সাধারণ মানুষের কাছে পাগলের প্রলাপ মনে হলেও ইলন মাস্কের কাছে এ যেন ছিল স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। মাস্কের স্বপ্ন একদিন অধরা মহাকাশ হবে মানুষের হাতের নাগালে। বাণিজ্যিকভাবে চালু হবে মহাকাশযান যাতে করে মানুষ ঘুরে আসতে পারবে তারা নক্ষত্র খচিত মহাকাশ। 

ফেলকন ৯; Image Source: Pexels

এ পর্যন্ত স্টারশিপ প্রজেক্ট

এ পর্যন্ত ৫ বার পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ হয়েছে স্টারশিপের। প্রথম পরীক্ষা হয় ২০২৩ এর এপ্রিলে। প্রথম বার রকেট বুস্টার থেকে আলাদা হওয়ার আগেই বিস্ফোরিত হয়ে গিয়েছিল মাত্র ৪ মিনিটে। নভেম্বর ১৮,২০২৩ এ দ্বিতীয় পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ হয়। দ্বিতীয় পরীক্ষায় বুস্টার থেকে রকেট সফলভাবে আলাদা হয়। মোট মাত্র ৮ মিনিটের এ উৎক্ষেপনের সময়ে কিছুক্ষণ পরই স্পেসএক্স স্পেসক্রাফট ও বুস্টার দুইটিরই নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং দুইটি আলাদা ভাবে বিস্ফোরিত হয়ে পরীক্ষাটি ব্যর্থ হয়ে যায়।

স্টারশিপ প্রজেক্টসমূহ; Image Source: Unsplash

১৪ মার্চ,২০২৪ এ স্টারশিপের তৃতীয় উৎক্ষেপণ হয়৷ এ উৎক্ষেপণ পরীক্ষায় অন্যান্য বার থেকে বেশ সফল হয়েছিল স্পেসএক্স। টেক্সাস থেকে উৎক্ষেপিত হওয়া রকেট স্টারশিপ এ দফায় ২৩০ কি.মি. পথ অতিক্রম করে মহাকাশে পৌঁছাতে সক্ষম হয় তবে আবার ল্যান্ডিং এর জন্য পৃথিবীতে ফেরত আসার সময় পৃথিবীর সীমারেখায় ঢুকতেই বিস্ফারিত হয়ে যায়। তবে এত দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করা ছিল স্পেসএক্স এর জন্য অনেক বড় সাফল্য। ২০২৪, জুলাইয়ের ৬, সকাল ৭ টা বেজে ৫০ মিনিটে স্টারশিপের চতুর্থ উৎক্ষেপণ হয়।  প্রায় ১ ঘন্টা ৬ মিনিটের সফল এ অভিযানে স্টারশিপ সফলভাবে পৃথিবীর সীমা অতিক্রম করে মহাকাশে পৌঁছায় এবং পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে এসে ভারতীয় মহাসাগরে পতিত হয়। পঞ্চম উৎক্ষেপণ হয় ১৩ অক্টোবর ২০২৪ এ।

পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট

ইলন মাস্কের স্বপ্ন স্পেসএক্সের মাধ্যমে তিনি মহাকাশ ভ্রমণকে সাধারণের জন্য করবেন উন্মুক্ত। কিন্তু মহাকাশ যাত্রা এতটাই ব্যয়বহুল যে খরচ কমিয়ে না আনা গেলে সাধারণের জন্য তা চির অধরাই রয়ে যাবে। তাই ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে ও পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব হ্রাস করার জন্য স্পেসএক্স পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট বানানর প্রয়াস চালাচ্ছে। পূর্বে রকেট উৎক্ষেপনের পর রকেটের নিচের অংশ বুস্টার রকেট নিক্ষেপের এক পর্যায়ে রকেট থেকে আলাদা হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ত। এ বুস্টার আর ব্যবহার যোগ্য থাকত না। রকেট উৎক্ষেপনকে আরও সাশ্রয়ী এবং পরিবেশ বান্ধব করতে বুস্টারকে পুনরায় ব্যবহার যোগ্য করার এক যুগান্তকারী আবিষ্কারে সফল হল স্পেসএক্স। তারা রকেট উৎক্ষেপনের পর আবার বুস্টারটি যখন ফেরত আসে তখন বিশাল দুই হাতের আকৃতির যন্ত্র দ্বারা বুস্টারটিকে বাতাসে ভাসমান থাকা অবস্থায় রীতিমতো ক্যাচ ধরে ফেলার মত করে ধরে সফল ভাবে অবতরণ করায়। স্পেসএক্সের উদ্দেশ্য মহাকাশযানকে আরও সাশ্রয়ী ও পুনরায় ব্যবহার যোগ্য করা। এর জন্য পুরো মহাকাশযানকে যেখান থেকে শুরু সেখানে আবার অবতরণ করাতে সক্ষম হতে হবে৷ সর্বশেষ স্পেসএক্সের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম তারই একটি ধাপ।  এতে প্রতি বার বুস্টার রকেটে অনেক খরচ হত যা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

কতখানি গ্রীন হাউস গ্যাস স্টারশিপ থেকে নির্গত হয়? 

ইউএস ফেডারেল অ্যাভিয়েশন এডমিনিস্ট্রেশনের জুলাইয়ে প্রকাশিত একটি রির্পোট অনুসারে স্পেসএক্স একটি নতুন লাইসেন্সের জন্য আবেদন করছে যাতে বছরে ২৫ টি স্টারশিপ উৎক্ষেপনের অনুমতি পায়৷ তাদের মতে এতে শুধুমাত্র একবার উৎক্ষেপনেই ৩৮৯৪ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে। যা পরিবেশের উপর তীব্র প্রভাব ফেলবে। যদিও এখনও ব্যাপারটি নিয়ে ইলন মাস্কের স্পেসএক্স পরিষ্কার কোনো বিবৃতি দেয় নি। 

বিলিওনিয়ারদের মহাকাশ প্রতিযোগিতা

পৃথিবীর অক্ষ ছাড়িয়ে মহাকাশ যাওয়ার প্রচেষ্টা শুধুমাত্র স্পেসএক্সের না, এ দৌড়ে রয়েছে আরেক বিলিওনিয়ার জেফ বেজসের ‘ব্লু অরিজিন’ ও। স্পেসএক্সের মত ব্লু অরিজিনেরও মুল লক্ষ্য পৃথিবীর সুবিধার্থে লাখো মানুষের বাসস্থান ও কর্মসংস্থান মহাকাশে করা। ২০২১ সালে ব্লু অরিজিন সফলভাবে মানুষ নিয়ে অর্ধ-অক্ষ মহাকাশ ভ্রমণ সম্পন্ন করে। ২০২১ সালের পর ৬ বার এটি মানুষসহ মহাকাশ ভ্রমণ করে। নাসা ২০২১ সালে একটি মিশন পরিকল্পনা করে যার উদ্দেশ্য রকেটের মাধ্যমে আবার চাঁদে মানুষের পদার্পণ করানো। এ পরিকল্পনার নাম দেয়া হয় আর্টেমিস প্রোগ্রাম।

স্পেসএক্স ও ব্লু অরিজিনের মহাকাশ প্রতিযোগীতা

নাসার আকর্ষণীয় এই প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত হবার জন্য প্রবল ইদুঁর প্রতিযোগিতা ছিল স্পেসএক্স ও ব্লু অরিজিন দুইটি কোম্পানির মধ্যেই। অবশেষে ২০২১ সালে নাসার সাথে এ প্রোগ্রামে যুক্ত হয় স্পেসএক্স। কয়েক মাস পর ব্লু অরিজিন নাসা ও স্পেসএক্স উভয় কোম্পানির নামে মামলা করে দেয়। পরবর্তীতে এ মামলা দফারফা হয়ে যায় এবং ২০২৩ সালে ব্লু অরিজিন নাসার সাথে তাদের নিজেদের নতুন একটি প্রজেক্টে চুক্তি করে৷  

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top