কঙ্গনা রানাওয়াতের কুইন সিনেমাটি দেখেছেন? সেখানে কঙ্গনা বিয়ের পরে হাসবেন্ডের সাথে হানিমুনে ফ্রান্সের প্যারিস যাবে বলে ঠিক করেছিল। যদিও পরে একাই ঘুরে আসে। এমনভাবে অনেক মানুষের লাইফ টাইমে বাকেটলিস্টে জায়গা করে নিয়েছে প্যারিস।
কি আছে ফ্রান্সে? বলুন কি নেই ফ্রান্সে। ফ্রান্সের বিখ্যাত প্রাসাদ প্যালেস অব ভার্সাই, লুভ্যর জাদুঘর, লিওনার্দো ভিঞ্চির মোনালিসা, মন্টমার্টের সরু রাস্তায় অ্যাকর্ডিয়নের শব্দ, ব্যাগুয়েট পেস্ট্রির গন্ধ! আহা! কি নেই! (1) সভ্যতা আর সংস্কৃতির মিশেলে যদি সেরা কোনো দেশ থাকে তার মধ্যে ফ্রান্সের নামটা রাখতেই হবে। তবে যতটা পরিপাটি আর সভ্য মুখোশধারী ফ্রান্সের মুদ্রার একপাশ ঠিক ততটাই ঘুটঘুটে অন্ধকার মুদ্রার অপর পাশটা। ফ্রান্সের উপনিবেশিক শাসনের কথা আমরা সবাই জানি। এ শাসন ব্যবস্থায় তারা কতটা নির্যাতন করেছিল পরাধীন মানুষগুলোকে সেটা কি জানি? এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল তাদের পারমানবিক এক্সপেরিমেন্ট! যে ক্ষত আজও প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বয়ে বেড়াচ্ছে আলজেরিয়া সাহারার মানুষ। আজ বলব সেই পারমানবিক এক্সপেরিমেণ্টের ভয়ংকর কিছু সত্য।
১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারীর ১৩ তারিখে ঠিক ভোরের ৭ টা বেজে ৪ মিনিটে দক্ষিণ আলজেরিয়ার সাহারা মরুভূমিতে বিশাল এক বিস্ফোরণ হল। পুরো বিশ্বে যখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত তখন গোপনে বিধ্বংসী এক এক্সপেরিমেন্টে ব্যস্ত ছিল ফ্রান্স। তাদের সর্বপ্রথম পারমানবিক বোমার পরীক্ষা সম্পন্ন করল দক্ষিণ আলজেরিয়ার রেগানে। পারমাণবিক বোমার নাম দেয়া হল জারবোইস ব্লু বা ব্লু জারবোয়া। আমেরিকা, রাশিয়া আর ইংল্যান্ডের পর এই এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে ফ্রান্স পারমাণবিক শক্তির চতুর্থ দেশ হিসেবে লিস্টে ঢুকে পড়ে। ৭০ কিলোটনের এই জারবোইস ব্লু এতটাই শক্তিশালী ছিল যে আমেরিকার হিরোশিমায় ফেলানো পারমাণবিক বোমা লিটল বয় থেকেও ৪ গুণ বেশি শক্তিশালী ছিল। কিন্তু এক্সপেরিমেন্টের সময়টা খুবই সেনসেটিভ ছিল। কারণ সে সময় আলজেরিয়াতে চলছিল স্বাধীনতার যুদ্ধ। যা ১৯৫৪ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত চলছিল।
এরপর ১৯৬০-১৯৬১ সালের মধ্যে একে একে আরো তিনটি পারমাণবিক বোমার এক্সপেরিমেন্ট করা হয়। ১৯৬০ সালের ১ এপ্রিল জারবোইস ব্লেংকে বা হোয়াইট জারবোয়া, ২৭ ডিসেম্বর জারবোইজ রগ বা রেড জারবোয়া, ১৯৬১ সালের ২৫ এপ্রিল জারবোইস ভার্তে বা গ্রিন জারবোয়া ফেলানো হয় সাহারার বুকে। ভয়ংকর এ ৪ টা পারমানবিক বোমার বিস্ফোরণই ফ্রান্স একদম খোলা জায়গায় করেছিল। বাতাসের প্রতিটা কণা তখন বিষের ভান্ডার। শ্বাস নিলেন তো মরলেন। পরিবেশের উপর ইম্পেক্ট কমাতে পরবর্তী ১৩ টা পারমাণবিক পরীক্ষা হল ইকের এলাকার আন্ডারগ্রাউন্ডে। ব্যাসিক্যালি আলজেরিয়ান সাহারা মরুভূমির হোগার পর্বতে।
১৯৬১ সালের ৮ জানুয়ারি ৭৫% জনগনের ভোটে বিজয়ী হয়ে ১৯৬২ সালে ১৩২ বছর পর ফ্রান্সের উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয় আলজেরিয়া। যদি ভেবে থাকেন যাবার আগে শেষবারের মত সব ধ্বংস করে দেবার জন্য পারমাণবিক বোমার এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে গেছে ফ্রান্স। তাহলে ভুল ভাবছেন। কারণ ১৯৬২ সালে আলজেরিয়া স্বাধীন হওয়ার পরেও আরও ৯ টি পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালানো হয়েছে আলজেরিয়াতে। সবমিলিয়ে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১৭ টা পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। আলজেরিয়া স্বাধীনতার পরে তৎকালীন আলজেরিয়ার অস্থায়ী সরকার, জাতীয় পার্টি আর ফ্রান্সের মধ্যে খুব গোপনে ইভিয়ান চুক্তি হয়। যার কারণে স্বাধীন হওয়ার পরেও আরও ৯টি এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিল ফ্রান্স।
তবে তারচেয়েও ভয়ংকর ঘটনা ঘটছিল পৃথিবীর মানুষের চোখের আড়ালে। যার উপযুক্ত প্রমাণ আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারে নি। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত অফিশিয়ালি পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর কথা সবাই জানলেও আসলেই কি ১৯৬৬ সালে সব শেষ হয়েছিল? ১৯৯৭ সালে ফ্রান্সের একটি ম্যাগাজিন Le Nouvel Observateur সবাইকে চমকে দিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয় ফ্রান্স আর আলজেরিয়ার হর্তাকর্তারা ১৯৬৬ সালে অফিশিয়ালি সব পারমাণবিক পরীক্ষার সমাপ্তির কথা বললেও ফ্রান্সের চারটা পারমাণবিক পরীক্ষা কেন্দ্র রেগানে, একের, কলম্ব বেচার্ড আর হামাগুইয়ের বন্ধ হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। যে সালে অদ্ভুত কারণে মারা যায় আলজেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী হোয়ারি বোউমেডিয়েনে। হোয়ারি বোউমেডিয়েনে ক্ষমতায় এসেছিল ১৯৬৫ সালে। গোপনে তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট দে গুয়ের সাথে একটি চুক্তি করেন। যার ফলাফল খুব গোপনে আলজেরিয়াতে ফ্রান্স পারমাণবিক আর বায়োকেমিক্যাল পরীক্ষা চালিয়ে যেতে থাকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। এর মানে ১৭ একটা চোখে ধুলো দেয়া সংখ্যা মাত্র। এর বেশি এক্সপেরিমেন্ট চালানো হয়েছে দক্ষিণ আলজেরিয়াতে। অনেকের মতে সংখ্যাটা আসলে ১৭ না ৫৭!!
পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা আলজেরিয়াতে চালানো হলেও এর রেডিওএক্টিভ রেডিয়েশন শুধু আলজেরিয়াতে সীমাবদ্ধ ছিল না। শুধুমাত্র প্রথম নিউক্লিয়ার বোমা জারবোইস ব্লু এর রেডিয়েশন একাই ছড়িয়ে গিয়েছিল আলজেরিয়া থেকে উত্তরে লিবিয়া আর মৌরতানিয়ায়, দক্ষিণে মালি আর নাইজেরিয়াতে। এমনকি স্পেন আর ইতালির কিছু অংশের বাতাসেও ২ সপ্তাহ ধরে রেকর্ড লেভেলের রেডিয়েশন পাওয়া গিয়েছিল প্রথম পরীক্ষার পরে।
প্রচন্ড বিষাক্ত এ রেডিয়েশনের প্রভাবে ৪২ হাজারেরও বেশি আলজেরিয় মারা গিয়েছিল। যদিও ফ্রান্স দাবি করেছিল যে জায়গায় পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা করা হয়েছে সে এলাকার আশেপাশে কোনো মানুষের বসতি ছিল না। কিন্তু স্থানীয় মানুষ বলছে ভিন্ন কথা। তাদের মতে আগে কোনো সতর্কবার্তা ছাড়াই পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। একে তো আগে সতর্ক করা হয় নি তার উপর পারমাণবিক বোমার এক্সপেরিমেন্ট ভুলভাবে সামলাতে গিয়ে প্রচুর প্লুটোনিয়াম আর তাপ সৃষ্টি হয়। বাতাসে রেডিয়েশন সব মিলিয়ে এত বেশি বেড়ে গিয়ে ছিল যে ৬৫ বছর পরে এখনও সেখানকার বাতাসে মিশে আছে সেই বিষাক্ততা।
শুধু তাই না ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করেছিল রেডিয়েশনের কারণে আশেপাশের ২৭,০০০ এর মত মানুষের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু আলজেরীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর আব্দুল কারিম আবউদীর হিসাব মতে প্রায় ৬০,০০০ এরও বেশি মানুষের ক্ষতি হয়েছে। শোনা যায় তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব পরীক্ষার জন্য আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বন্দী হওয়া ২৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে এই ধ্বংসাত্মক পরীক্ষার গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে। এই ২৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আলজেরিয়ার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের যোদ্ধা। আধুনিক গবেষণা মতে ফ্রান্স যখন পারমাণবিক বোমার এক্সপেরিমেন্ট করছিল ঠিক সে সময়ে রেগানের ভেতর, আশেপাশে বা ঘুরতে অন্তত দেড় লাখ মানুষ উপস্থিত ছিল। সত্যি বলতে উপনিবেশিক শাসক ফ্রান্সের মুখ্য কর্তারা এতটাই ফ্যাসিস্ট আর রেসিস্ট ছিল যে তাদের অধীনস্থ দেশগুলোর মানুষদেরকে কখনো মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করে নি। তাদের কাছে অধনস্থ মানুষগুলো কীট পতঙ্গের চাইতে বেশি কিছু ছিল না।
আলজেরিয়ার মরুভূমিতে প্রথম ফরাসি পরমাণু বোমার পরীক্ষায় খরচ হয়েছিল ১২৬ কোটি ফ্রাঙ্ক। আর ফিলিস্তিন দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে পরমাণু-সহযোগিতা চুক্তির আওতায় প্যারিসকে ওই অর্থের যোগান দিয়েছিল তেল-আবিব। এক্সপেরিমেন্ট শেষে আলজেরিয়া থেকে যখন চলে যাবার সময় আসল তখন পারমাণবিক পরীক্ষার কেন্দ্র, পরীক্ষার সব সরঞ্জাম বেশির ভাগই খোলামেলা রেখে দিল যা কিনা রেডিওএক্টিভ রেডিয়েশনের সংস্পর্শে ছিল। কিছু জিনিস আবার সাহারা মরুভূমির বালির কেবল ৪/৫ ফিট নিচেই চাপা দেয়া হল। যা কয়েক বছর পরে বালি সরে আবার খোলা বাতাসের সংস্পর্শে চলে আসল। মানে এত বিপদজনক একটা পরীক্ষার পরে স্থানীয় মানুষের ক্ষতিগুলোর কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়ে, আলজেরিয়ান সাহারার পরিবেশকে বিষাক্ততা থেকে মুক্ত না করে, বিষাক্ত সরঞ্জামাদি ঠিকভাবে না সরিয়ে পুরোপুরি দায়সাড়া ভাবে বিদায় নিল বর্বর ফ্রান্স। যার কারণে আজ এত বছর পরেও সেখানের পরিবেশ মারাত্মক বিষাক্ত। পারমাণবিক পরীক্ষার সময়ে রেডিয়েশনে এক্সপোজ হওয়া মানুষগুলো বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার, প্রজন্মের পর প্রজন্ম শারীরিক বিকৃতি, বিকলাঙ্গতা নিয়ে বেচে আছে।
অথচ এত বড় এক্সপেরিমেন্ট! এতগুলো মানুষের জীবন! পুরো আফ্রিকার একাংশের পরিবেশ ধ্বংস করেও এ যাবত পর্যন্ত একটা বারও ফ্রান্স নিজেদের কৃতকর্মের জন্য কোনো অনুশোচনা করে নি। স্বীকার করে নি নিজেদের ভুল নাকি তারা এমন বর্বরতাকে ভুল বলেই মনে করে না।
১৯৬৬ সালে ফ্রান্স তার পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষার জায়গা পরিবর্তন করে আলজেরিয়া থেকে নিয়ে যায় ফ্রান্স উপনিবেশের শাসনাধীন ফ্রেঞ্চ পলিনেসিয়াতে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ফ্রান্স সেখানেও খোলা জায়গায় আর মাটির নিচে প্রায় ২০০ টার মত পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা চালায়। এ পরীক্ষা চলে ১৯৬৬ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মানে প্রায় ২০ বছর ধরে।