শুধু এই বছরের সেপ্টেম্বর মাসেই স্বর্ণের দাম বেড়েছে ১০ বার! মানে এক সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ বারের মত বেড়েছে দাম। মাঝে কমেছেও বেশ কয়েকবার। কিন্তু যত কমে তারপরেই লাফিয়ে আবার দ্বিগুণ বেড়ে যায় দাম। স্বর্ণ এখানে জাস্ট একটা ইন্ডিকেটর। যেটা দেখাচ্ছে পৃথিবীর অর্থনীতি আসলে কোন দিকে ঘুরপাক খাচ্ছে।
স্বর্ণের দামের সাথে একটা স্ট্রং কানেকশন আছে অর্থনীতির। কিংবা বলা যায় অর্থনীতির নীতি নিয়ে টানাটানি করলেই স্বর্ণের দামের তফাতটা দেখা যায় বাজারে। কারণ খুব সহজ স্বর্ণের দামে অদৃশ্যভাবে লিখা আছে যুদ্ধ, শুল্ক, সুদের হার, অর্থনৈতিক উত্থান পতন কিংবা পলিটিক্যাল টেনশন।
অর্থনীতিতে ‘স্ট্যাগফ্লেশন’ বলতে একটি কথা আছে। মূল্যস্ফীতি মানে ইনফ্লেশন আর স্থবিরতা যেটাকে ইংরেজিতে বলে স্ট্যাগন্যান্ট—এই দুটি শব্দকে এক করে বলা হয় স্ট্যাগফ্লেশন কথাটি। স্ট্যাগফ্লেশন হচ্ছে এমন এক অর্থনীতি, যেখানে প্রবৃদ্ধি কমে থাকে, মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে সাথে বাড়ে বেকারত্ব। দেখবেন বিশ্বে যুদ্ধ বা জিও পলিটিকাল টেনশন হলেই ব্যবসা, বিনিয়োগ কমে যায়। কমে কাগজের টাকার মূল্যও। ব্যাংক তখন সংকট কাটাতে অতিরিক্ত টাকা ছাপতে শুরু করে। সাময়িক ভাবে অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়ে অর্থনীতিকে বাচানো গেলেও লম্বা সময়ের জন্য সেটা অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে। এই রকম সময়ে বিনিয়োগকারী বলুন বা সাধারণ মানুষ সবাই নিজেদের সম্পদকে সংরক্ষণ করার জন্য ঝুকে পড়ে স্বর্ণের দিকে। কারণ টাকার মূল্য বাড়লে বা কমলেও শুধুমাত্র স্বর্ণই এমন একটা বস্তু যার দাম সময়ের সাথে শুধু বাড়তেই থাকে, কখনো কমে যায় না।
কিন্তু কেন? কিভাবে এই স্বর্ণের উপর ডিপেন্ড করে জিওপলিটিক্সের জাল বোনা হচ্ছে? কেন বিশ্ববাজারে ডলারের দাম বাড়ে কমে? কেন স্বর্ণের উপর ডিপেন্ড করে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে?
গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো রেকর্ড পরিমাণ স্বর্ণ মজুদ করছে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ইন্টারন্যাশনাল রোল অফ দ্য ইউরো ২০২৫’ রিপোর্ট অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর হাতে এখন ৩৬ হাজার টনেরও বেশি স্বর্ণ রয়েছে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ৪৩ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী বছরে আরও স্বর্ণ কেনার পরিকল্পনা করছে, আর ৯৫ শতাংশ মনে করছে বিশ্বব্যাপী স্বর্ণের মজুদ আরও বাড়বে।
তো স্বাভাবিকভাবেই কোন জিনিসের ডিমান্ড বাড়লে সেটার দামটাও বেড়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো স্বর্ণ মজুদের হার বাড়িয়ে দেয়ার সাথে সাথে বাজারেও স্বর্ণের দাম আকাশ ছুঁয়েছে।
সব ইকুয়েশন মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে স্বর্ণই সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ। সারা বিশ্বের মানুষ যখন ঝুঁকছে স্বর্ণে বিনিয়োগের দিকে তখন আপনি আর পিছিয়ে থাকবেন কেন?
ধরেন আপনি এক লাখ টাকা হাতে পেলেন। কোথায় রাখবেন? ব্যাংকে, নাকি স্বর্ণ কিনে? আসলেই কোনটা বেশি লাভজনক? প্রথমেই বলে রাখি আমি কোনো ধরনের সুদকে প্রমোট করছি না৷ শুধুমাত্র ডিফারেন্সটা বুঝাচ্ছি। আসি ব্যাংকের কথায়। বাংলাদেশে এখন গড়ে ব্যাংক ডিপোজিটে সুদের হার প্রায় ৬% এর মতো। তবে কিছু কিছু ব্যাংক ফিক্সড ডিপোজিটে দিচ্ছে ১০ থেকে ১০.৫% পর্যন্ত।
ধরা যাক, আপনি ১ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা রাখলেন এক বছরের জন্য, ১০.৫% হারে। তাহলে এক বছর শেষে সুদ পাবেন প্রায় ১০,৫০০ টাকা। অর্থাৎ মোট টাকা দাঁড়াবে ১ লাখ ১০ হাজার ৫০০।
এবার আসি স্বর্ণে।ধরলাম সেই এক লাখ টাকা দিয়ে আপনি স্বর্ণ কিনলেন, তখন ভরি প্রতি দাম ধরা হলো ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এক বছর পরে যদি স্বর্ণের দাম ২০% বেড়ে যায়, অর্থাৎ ভরি প্রতি দাম হয় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা, তাহলে আপনার সেই স্বর্ণের বাজার মূল্য দাঁড়াবে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। মানে লাভ হলো ২০ হাজার টাকা। বিশ্ববাজারে স্বর্ণের চাহিদা বাড়লে এই লাভের পরিমাণ আরও অনেক বেশি বাড়তেও পারে। মানে আপনি যদি ব্যাংকে টাকা রাখেন তাহলে সুদ সমেত যে টাকা পাবেন তার থেকেও বেশি লাভ করবেন সনি ইনভেস্ট করলে । সুদও খাওয়া লাগল না আবার লাভটাও বেশি।
স্বর্ণ আর রাজনীতি
স্বর্ণকে ঘিরে রাজনীতির প্রসঙ্গ তুললে ডলারের কথা চলেই আসে। ডলার আর গোল্ডের সম্পর্কটা বেশ পুরনো। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর ৪৪ টি দেশের প্রতিনিধি New Hampshire এর Bretton Woods নামের একটা জায়গায় একসাথে হয়ে একটা নতুন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেয়। যেটাকে বলা হয় Bretton Woods system. সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বিশ্বের মেইন রিজার্ভ কারেন্সি হবে মার্কিন ডলার। মানে স্বর্ণের সাথে ডলারের সরাসরি কানেকশন হবে। সে হিসেবে ১ আউন্স স্বর্ণের মূল্য হবে ৩৫ মার্কিন ডলার। অনেক বছর পরে ১৯৭১ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন আবার এই সিস্টেম বন্ধ করে দেন। কিন্তু ততদিনে সব দেশ সরাসরি ডলার আর US Treasury Bond-কে রিজার্ভ সম্পদ হিসেবে ধরে রাখতে শুরু করে দিয়েছিল। কারণ ডলার অলরেডি বিশ্ব বাণিজ্যের মুদ্রা হয়ে গেছে। এছাড়াও ১৯৭০ এর দশকে পেট্রোডলার চুক্তির পর বিশাল তেল বাণিজ্য ডলার ভিত্তিক হয়ে যাওয়াতে ডলার এবং ডলার বন্ড বিশ্ব রিজার্ভের প্রধান অংশ হয়ে যায়। ডলার বন্ড হয়ে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে সহজে কেনাবেচা করা যায় এমন সম্পদ। যেখানে স্বর্ণ বিক্রি করা সময়ের ব্যাপার আর দাম ওঠানামার ঝুঁকিও থাকে সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি হঠাৎ নগদ ডলার দরকার পড়ে, তাহলে মার্কিন ট্রেজারি বন্ড মুহূর্তেই বিক্রি করে ডলার ক্যাশে রূপান্তর করতে পারে। আবার স্বর্ণ ব্যাংকে পড়ে থাকলে কোনো সুদ দেয় না। কিন্তু ডলার বন্ড রাখলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ পায়।
ডলারের সহজ বিনিময়, গ্রহণযোগ্যতা, আয় করার সুবিধা সবকিছু ডলারকে বানালো কিং অফ অল কারেন্সি। এই ডলারের সাথে স্বর্ণের সম্পর্কটা কিন্তু ব্যস্তানুপাতিক। ডলারের দাম বাড়লে স্বর্ণের দাম কমে, আর ডলারের দাম কমলে স্বর্ণের দাম বাড়ে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের মূল্যায়ন হয় মার্কিন ডলারে।
যদি ডলার শক্তিশালী হয়, তাহলে অন্যান্য মুদ্রাধারীদের স্বর্ণ কিনতে বেশি খরচ হয়। খরচ বেশি লাগলে স্বর্ণের চাহিদা কমে যায়। আর চাহিদা কমে গেলে স্বর্ণের দামও পড়ে যায়।
আবার যখন ডলার দুর্বল হয় তখন স্বর্ণ তুলনামূলক সস্তা হয়ে যায়। সস্তা হয়ে গেলে স্বর্ণের চাহিদা বাড়ে। আর যত ডিমান্ড তত বেশি দাম।
এই ডলার শক্তিশালী হয় কিন্তু তখনই যখন মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ডলার বন্ডের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তখন বেশি সুদ পেতে ডলার-ভিত্তিক সম্পদে বিনিয়োগ করে। টুইস্টটা এখানে, বেশ কয়েক বছর ধরে আমেরিকা ঋণের বোঝা টানছে প্রতিবছর। রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি, যুদ্ধ বিগ্রহ সবকিছু মিলিয়ে ঋণের বোঝা শুধু বেড়েই যাচ্ছে। ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধ বন্ধ তো করতেই পারে নাই, উল্টো স্যাংশান দেয়া কিংবা শুল্কযুদ্ধের মত ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে অনেক দেশের সাথে।
অর্থনীতির রীতিনীতি নিয়ে যেন রীতিমতো খেলছে ট্রাম্প। রিসেন্টলি ফেডারেল রিজার্ভের উপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে। যার একটা কারণ সুদের হার কমাতে চাওয়া। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট চাইছে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেন ডলার বন্ডের সুদের হার কমিয়ে দেয়। ডলারের টালমাটাল অবস্থা দেখে বিনিয়োগকারীরাও আর রিস্ক নিতে চাইছে না৷ তারা খুঁজছে অল্টারনেটিভ অপশন। যেটার বেস্ট সলিউশন হচ্ছে গোল্ড। এই যেমন প্রচুর দাম হওয়া সত্ত্বেও চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেভাবে স্বর্ণ কেনা জারি রেখেছে, তা থেকেই বোঝা যায় ডলারনির্ভরতা কমাতে বেইজিং কতটা তাড়াহুড়া করছে। ফেব্রুয়ারি মাসে যেখানে চীনের হাতে ছিল ৭৮৪ বিলিয়ন বা ৭৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের মার্কিন ঋণপত্র, এপ্রিলের শেষে তা কমে দাঁড়ায় ৭৫৭ বিলিয়ন বা ৭৫ হাজার ৭০০ কোটি ডলারে। অর্থাৎ দুই মাসে কমেছে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার। চীনের মত রাশিয়া, ভারতসহ অনেক দেশই ডলারের অল্টারনেটিভ অপশন হিসেবে গোল্ড কে বেছে নিচ্ছে। বলা হচ্ছে তিন দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বন্ডের তুলনায় বেশি স্বর্ণ মজুদ করছে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো।
বিশ্বের স্বর্ণের দিকে ঝুঁকে পড়ার
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো স্বর্ণের দিকে ঝুঁকে পড়ার তিনটি কারণ খুঁজে বের করেছে এনালিস্টরা। প্রথমত, ডলারের মত স্বর্ণের উপর কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা প্রতিষ্ঠান কারো কন্ট্রোল নাই। চাইলেই স্বর্ণের রিজার্ভে স্যাংশান দিয়ে একটা দেশের অর্থনীতিকে বানচাল করে দেয়া যায় না। মেইনলি ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের পর আমেরিকা যখন রাশিয়ার ডলার ও ইউরো রিজার্ভের উপর স্যাংশান দেয় তখন থেকেই বিভিন্ন দেশের টনক নড়ে। সবাই তখন স্যাংকশন-প্রুফ সম্পদ খুঁজতে শুরু করে।
দ্বিতীয়ত, আমেরিকার ঋণের মাত্রা দিনকে দিন বাড়ছে। তাই মার্কিন বন্ডে অতিরিক্ত ভরসা রাখতে চাইছে না অনেক দেশ।
৩ নাম্বার কারণ হতে পারে সব দেশ ডলারের উপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে, চাইছে ডিফারেন্ট এসেট দিয়ে রিজার্ভ ভারী করতে। যেটা কিনা হবে ডলারের চেয়ে স্টেবল। মোদ্দা কথা স্বর্ণের উপর ডিপেন্ড করে মোটামুটি এখন পুরো বিশ্বই চাইছে অর্থনীতির দিক থেকে স্টেবল হতে।
প্রাচীন মিশরীয়, রোমান কিংবা ইনকা সভ্যতার মত শক্তিশালী সম্রাজ্যের মূল সম্পদ ছিল স্বর্ণ। চিন্তা করে দেখেন, স্বর্ণের সেই দাপট কিন্তু সময়ের সাথে কমে নাই বরং আরো বেড়েছে। সব জিনিসই একটা সময় নস্ট বা ক্ষয় হয়ে যায়। অথচ স্বর্ণ কোনো ধরনের ক্ষয় হয় না বা ওজনে কমে না। সাথে লিমিটেড পরিমাণে থাকায় চাহিদার ব্যাপার তো আছেই। এই গুণগুলোর জন্যই বিনিময়ে স্বর্ণের perfect বিকল্প হয়ত কখনোই আসবে না। কাগুজে টাকা হয়ত ছিড়ে যাবে, নষ্ট হবে, ক্রিপ্টো কারেন্সিতে দরপতন বা স্ক্যামিং হতে পারে। কিন্তু হাজার বছর পরেও স্বর্ণ থাকবে অবিকল একই রকম। বিনিয়োগের জগতে এমনি এমনি তো আর একে সেফ হেভেন ডাকা হয় না।



