ডায়নোসরের বিলুপ্তি হয়েছিল পৃথিবীতে উল্কাপিন্ডের আঘাত হানার মাধ্যমে, মানুষের বিলুপ্তি কি তবে নিজেদের হাতেই? সারা বিশ্ব বর্তমানে প্রস্তুতি নিচ্ছে সাম্ভাব্য বড় আসন্ন এক যুদ্ধের। রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের উত্তাপ শুধু এই দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য দেশের মধ্যেও। শক্তিধর দেশগুলো আরও শানিত করছে নিজেদের অস্ত্র প্রযুক্তি। এক দেশ অপর দেশকে দিচ্ছে পারমানবিক হামলার হুমকি। কিভাবে শুরু হল এই যুদ্ধ? কেন দীর্ঘায়িত হচ্ছে? কিই বা এর ভবিষ্যৎ?
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম সূচনা
২০১৪ সাল থেকে মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু। তৎকালীন ইউক্রেনের রাশিয়া সমর্থিত প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোচ ইইউ তে যোগ দিতে সমর্থন না দেওয়ায় সাধারণ জনগণ ব্যাপক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষের গণ আন্দোলনের মুখে ভিক্টর ইয়ানুকোচ ইউক্রেন ছেড়ে পালিয়ে যায়৷ ইয়ানুকোচের পলায়নের পর ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারি অস্ত্র সজ্জিত আর্মির একদল মুখোশ পরিহিত লোক ক্রিমিয়ার সরকারি ভবনগুলো দখল করে নেয়। এ নিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি এ ব্যাপারে কিছু জানার ব্যাপারে অস্বীকার করেন। পরবর্তীতে পুতিন খোলাখুলি ভাবে স্বীকার করেন যে লোকজন ক্রিমিয়ার সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো দখল করেছে তারা তারই লোক৷ এই অস্ত্র সজ্জিত লোকগুলোকে রাশিয়ার ‘লিটল গ্রিন ম্যান’ বলা হয়। পুতিন ক্রিমিয়ায় সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তায় ১৬ মার্চ ২০১৪ সালে গণভোট আয়োজন করেন৷ ক্রিমিয়া কি ইউক্রেনের অংশ হয়ে থাকবে নাকি রাশিয়ার সাথে যুক্ত হবে? এই প্রশ্নের উপর আয়োজিত হয় এই গণভোট। ৯৭ ভাগ ক্রিমিয়ার জনগণ এ ভোটে রাশিয়ার সাথে একই রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেয়। পরবর্তীতে এ ফলাফলের উপর ভিত্তি করে ১৭ মার্চ ক্রিমিয়া নিজেকে স্বাধীন দেশ ঘোষণা করে এবং রুশ ফেডারেশনের সাথে যুক্ত হওয়ার আবেদন জানায়। ২১ মার্চ বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়ার পরে রুশ ফেডারেশনের সাথে যুক্ত হয়ে যায় ক্রিমিয়া৷ কিন্তু রাশিয়া ক্রিমিয়াকে যতই নিজের অংশ বলে দাবি করুক না কেন পশ্চিমা বিশ্বের কাছে এখনো গণভোটটি অবৈধ এবং ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ মানতে তারা নারাজ।
২০১৪ থেকে ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় রাশিয়া পন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে ইউক্রেনের দফায় দফায় যুদ্ধ চলতে থাকে। ২০১৯ সালে ইউক্রেনের নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হয় ভ্লাদিমির জেলেনেস্কি। টেলিভিশনে অভিনেতা ও কমেডিয়ান জেলেনেস্কি তার দুর্নীতি বিরোধী মনোভাবের জন্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান এবং ২০১৯ সালের নির্বাচনে প্রতিপক্ষ পোরোসেনকোকে হারিয়ে ইউক্রেনের নতুন প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। জেলেনেস্কি জয়ী হওয়ার পর দনবাস অঞ্চলে যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টা করেন। আমেরিকা থেকে বিভিন্ন নিরাপত্তা ও চিকিৎসার সহায়তা নেন। ইউক্রেনের পূর্বের সব প্রেসিডেন্ট ছিল রাশিয়াপন্থী। কিন্তু জেলেনেস্কি নিজের দেশের স্বাধীন, সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী ছিলেন।
তিনি ২০২০ এ রাশিয়াকে শত্রু দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং নিজেদের সুরক্ষার জন্য আমেরিকার কাছে ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ব্যাপারটি রাশিয়াকে একই সাথে রাগান্বিত ও চিন্তিত করে তোলে। কারণ রাশিয়ার চির শত্রু আমেরিকার যদি ন্যাটোর ঘাটি রাশিয়ারই প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে গড়ে তোলে তবে এটি রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য প্রচন্ড হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এরই ধারায় রাশিয়া ২০২১ এর অক্টোবর -নভেম্বর মাসে ইউক্রেনের বর্ডারে সামরিক ঘাটি গড়ে তুলে ইউক্রেনকে পরোক্ষভাবে হুমকি দেয় আক্রমণের৷ ধীরে ধীরে মালডোভা, ক্রিমিয়াসহ রাশিয়া ইউক্রেনের প্রতি বর্ডারে মিলিয়ে মোট ১ লাখ ৯০ হাজারের মত রাশিয়ান সৈন্য মোতায়েন করে ইউক্রেনকে ঘিরে ফেলা হয়। এ যেন সরাসরি হুমকি যে ন্যাটোতে যোগ দিলে ইউক্রেনের উপর হামলা হতে পারে যে কোন মুহূর্তে। তবে পুতিনকে বর্ডারে সামরিক মহড়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি সরাসরি এই তথ্য অস্বীকার করে বলেন সাধারণ মহড়ার জন্য বর্ডারে সামরিক ঘাটি করা হয়েছে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে পশ্চিমা দেশগুলোর নেতারা পুতিন ও জেলেনেস্কি উভয়ের সাথে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে রাশিয়া দাবি করে ১৯৯০ সালে আমেরিকার সাথে চুক্তি হয়েছিল ন্যাটো তার সদস্য সংখ্যা আর বাড়াবে না এবং পূর্ব দিকের দেশগুলোতে আর আগাবে না। কিন্তু আমেরিকা সে চুক্তি ভঙ্গ করছে। আমেরিকাকে পূর্ব দিকের দেশ গুলো থেকে সরে যেতে হবে এবং ইউক্রেনকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে না তাহলেই কেবল ইউক্রেনকে রাশিয়া আক্রমণ করবে না। আমেরিকা সাফ নাকচ করে দেয় এই প্রস্তাব।
অবশেষে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক হামলার নির্দেশ দিয়ে যুদ্ধের শুরু করে রাশিয়া। রাশিয়ার শক্তির কাছে ইউক্রেনের মত চুনোপুঁটি দেশ এক সপ্তাহের ভিতরেই পরাজিত হবে বলে ধারণা করেছিল অনেকেই। কিন্তু সবার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে এই যুদ্ধ চলছে প্রায় আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে।
যুদ্ধে দুই দেশের নিহতের হিসাব
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আহত ও নিহত হওয়া মানুষের প্রকৃত তথ্য কোনো দেশই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নি।এর পেছনের একটি কারণ হল সঠিক তথ্য বের হয়ে আসলে শত্রুপক্ষ প্রতিপক্ষকে কতটুকু দুর্বল করতে পেরেছে তা বুঝে যাবে। তবে বিভিন্ন উন্মুক্ত তথ্যসূত্র ও মিডিয়ার অনুসন্ধান থেকে ধারণা করা যায় আনুমানিক ২০২৪ এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিবিসি ও মিডিয়াজোনা ৪৫ হাজার নিহত রুশ সেনার তথ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা ৮০ হাজারের কাছাকাছি হতে পারে। অপরদিকে ২০২৪ এর ফেব্রুয়ারিতে ভ্লাদিমির জেলেনেস্কি বলেছেন তাদের নিহত সৈনিকের সংখ্যা প্রায় ৩১০০০ হবে, এর চেয়ে বেশি নয়। তবে যতই তিনি যতই অস্বীকার করুক না কেন আমেরিকার তথ্য অনুযায়ী প্রকৃত সংখ্যা যে এর থেকে অনেক বেশি।
এত লম্বা সময় ধরে যুদ্ধ কেন চলছে?
রাশিয়ার শক্তির সামনে ইউক্রেনের খুব সহজেই ভেঙে যাওয়ার কথা থাকলেও এত লম্বা সময় ধরে ইউক্রেনকে যুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকার সামগ্রে জোগাচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো।অত্যাধুনিক অস্ত্র,উন্নত প্রশিক্ষণ, ত্রান, চিকিৎসা, অর্থনৈতিক সাহায্য ইত্যাদি সহায়তা দিয়ে দেশগুলো ইউক্রেনের সামরিক শক্তিকে এমন মজবুত করে তুলেছে যে রাশিয়ান সামরিক শক্তিকে অনেকটুকুই রুখে দিতে সক্ষম হয়েছে। ফাইটার জেট, ফাইটিং ফেলকন, স্টারস্ট্রেক মিসাইল, ক্লাস্টার বোম, ট্যাংক, ৮০ ধরনের লঞ্চ রকেট সিস্টেম, মিসাইল ইত্যাদি দিয়ে ইউক্রেনকে সহায়তা করছে প্রায় ২৯ টি দেশ। ইইউ এর সবকয়টি দেশ এ যুদ্ধে রাশিয়ার বিপক্ষে অবস্থান করছে এবং ইউক্রেনকে সব ধরনের সহায়তা করছে। ৪৫ টি দেশ রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু কোনোভাবেই তারা রাশিয়াকে একঘরে করতে পারে নি।
ইউক্রেনকে সাহায্য করে আমেরিকার কি লাভ?
একটি যুদ্ধ দেশের সামরিক, অর্থনৈতিক ভিতকে পিছিয়ে দেয় কয়েক বছর। যে যুদ্ধ শেষ হতে কয়েকদিনও লাগবে না বলে মানুষ ধরে নিয়েছিল সে যুদ্ধ এখন দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকেই আঙ্গুল তাক করে আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে৷ প্রতিনিয়ত তাদের প্ররোচনায় যুদ্ধের গতি ক্রমে বেড়েই চলছে। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধে আমেরিকার এত অর্থ খরচ করে সাহায্য করায় আমেরিকার নিজের কি লাভ? অবশ্যই দুনিয়ার কিছুই একপাক্ষিক না, আমেরিকার ক্ষেত্রে তো তা আরও নিরেট সত্য। ইউক্রেন ও আমেরিকা দুই পক্ষই নিজের সুবিধার্থে একে অপরের পাশে আছে। ইউক্রেনের এখন প্রয়োজন অস্ত্রশস্ত্র ও বড় ধরনের অর্থনৈতিক, সামরিক সাহায্য যা আমেরিকা গত দুই বছর ধরে করে যাচ্ছে। বদলে আমেরিকা তবে কি পাচ্ছে? রাশিয়া আমেরিকার শত্রুতার ইতিহাস বহু পুরাতন। রাশিয়ার সাথে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ছাড়াই এ যুদ্ধে ইউক্রেনের সহায়তা করার মাধ্যমে আমেরিকা রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে আঘাত করার মাধ্যমে দুর্বল করে দিতে সফল হচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে রাশিয়া সামরিক শক্তির দিক থেকে আমেরিকা থেকে অনেক খানি পিছিয়ে থাকবে৷ এছাড়াও রাশিয়াকে এ যুদ্ধে ব্যস্ত রেখে আমেরিকা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিক যেমন হঠাৎ অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে যাওয়া চীনের দিকে নজর দিতে পারছে। ইউক্রেনের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার সত্যিকার সামরিক শক্তি ও কৌশল সম্পর্কে ধারণা নিতে পারছে যা তাদের নিজস্ব সামরিক প্রস্তুতিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে৷ নিজেদের সৈন্য দিয়ে যুদ্ধা করানো ছাড়াই রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারছে এবং এ সুযোগে নিজেদের বৈদেশিক কুটনৈতিক সম্পর্ক আরও উন্নত করছে।
যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি
১৯ নভেম্বর রাশিয়া নিজেদের পারমাণবিক নীতিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে নতুন বদল আনে। পূর্বে রাশিয়ার পারমাণবিক নীতি ছিল যদি রাশিয়ার উপর কোন ধরনের পারমাণবিক, রাসায়নিক ও বায়োলজিক্যাল আক্রমণ হলে এমনকি সাধারণ অস্ত্র দিয়ে বড় আকারের হামলা হলেও রাশিয়া নিউক্লিয়ার বোমা ব্যবহার করতে পারবে যদি রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাতে আঘাত হানা হয়।
নতুন নীতি অনুসারে রাশিয়া ও রাশিয়ার বন্ধু রাষ্ট্র উভয়ের উপরই যে কোন ধরনের হামলা হলেও তা রাশিয়াকে নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেবে৷ এছাড়াও যদি কোনো নিউক্লিয়ার অস্ত্র বিহীন রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সহযোগীতা নেয় ও হামলা করে তবে তা সম্মিলিত আক্রমণ বলে গণ্য হবে। তখন যে রাষ্ট্র সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল তার উপরও আক্রমণ হতে পারে। এছাড়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যালিস্টিক মিসাইল দিয়ে আক্রমণ হলেও রাশিয়ার সে দেশের উপর নিউক্লিয়ার হামলা চালাতে পারে। রাশিয়ার নতুন এই পারমাণবিক নীতি অন্যান্য দেশগুলোর জন্য স্পষ্ট পারমাণবিক হামলার হুমকি। আনুষ্ঠানিক ভাবে নীতিগুলো প্রকাশিত হবার পরপরই নড়েচড়ে বসে পশ্চিমা দেশগুলো। জার্মানি, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে এখন থেকেই আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে।
এই যুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক দেশ আমেরিকায় ২০২৪ এর নিবার্চনের পর ক্ষমতায় আসে বড় রদবদল। ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণায় বলেছিল ক্ষমতায় আসলে একদিনেই বন্ধ করবে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ৷ ট্রাম্প নির্বাচনে জয়ী হবার পর ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে হোয়াইট হাউসে বাইডেনের শেষ কিছু দিনে নেওয়া এক সিদ্ধান্তে পুরো বিশ্বের রাজনৈতিক সমীকরণকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে যান৷ পূর্বে রাশিয়ার আগ্রাসন ও পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে ভেবে ইউক্রেনকে আমেরিকা ও যুক্তরাজ্য লং রেঞ্জ মিসাইল দিলেও, তা ব্যবহারের অনুমতি দেয় নি৷ তবে বাইডেন যেতে যেতে ইউক্রেনকে লং রেঞ্জ মিসাইল ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে দেন। অনুমতি পাবার পরপর ইউক্রেন রাশিয়ার ৩০০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে আমেরিকার তৈরি লং রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল ATACMS এবং যুক্তরাজ্যের তৈরি “স্ট্রোম শ্যাডো” নামক লং রেঞ্জ মিসাইল নিক্ষেপ করে। আকস্মিক এ মিসাইল হামলায় রাশিয়া ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয় এবং ঘোষণা দেয় এটি আর আঞ্চলিক যুদ্ধ নয়, এটি এখন বৈশ্বিক যুদ্ধে পরিণত হয়েছে৷ রাশিয়া জবাবে হাইপারসনিক মিসাইল ওরেশনিক নিক্ষেপ। অত্যাধুনিক এ ক্ষেপণাস্ত্র পশ্চিমা বিশ্বের নেতাদের মধ্যে ভীতি তৈরি করেছে যার ফলে তারা রাশিয়ার পারমাণবিক হামলা করার হুমকিকে গুরুত্বের সাথে দেখছে।
এদিকে উত্তর কোরিয়া ও ইরান এ যুদ্ধে রাশিয়ার সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। ইরান তার উন্নত শক্তিশালী অস্ত্র সরবরাহ করছে, অপরদিকে উত্তর কোরিয়া কয়েক হাজার সৈন্য ইতোমধ্যে রাশিয়া পাঠিয়ে দিয়েছে। কুরুস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনীয় সেনাদের সাথে উত্তর কোরিয়ার সেনাদের লড়াইয়ের খবর এরই মধ্যে প্রকাশ হয়েছে। উত্তর কোরিয়ার মতে ইউক্রেন রাশিয়ার ভেতরে মিসাইল হামলা করে রাশিয়ার নিরাপত্তায় আঘাত হেনেছে। তাই পালটা জবাব দিয়ে রাশিয়ার আত্মরক্ষা করার অধিকার রয়েছে। এমনকি প্রয়োজন পড়লে রাশিয়াকে পারমাণবিক সহায়তা দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছে উত্তর কোরিয়া।
এর মধ্যে যুদ্ধে রুশ বাহিনী ইউক্রেনের ২৩৫ বর্গ কিলোমিটার বা ৯১ বর্গ মাইল এলাকা দখল করেছে। নভেম্বরে রুশ বাহিনী ইউক্রেনের ৬০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা দখল করেছে। ইউক্রেনের দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, ঝাপোরিজ্জিয়া এবং খেরসন এই চার প্রদেশ আয়ত্তে নিয়ে নিয়েছে এবং রাশিয়ার ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷
ইউক্রেনে ২০২৪ সালে অন্যান্য বছর থেকে সবচেয়ে বেশি সৈন্য যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গিয়েছে। বছরের পর বছর যুদ্ধ করতে করতে পরিশ্রান্ত ইউক্রেনিয়ান সৈন্যদের মধ্যে আনুমানিক ৩০০০০ সৈন্য এ বছর পালিয়ে গেছে। যেটি ২০২৩ এ ছিল ২২০০০ এবং ২০২২ এ ছিল ৯০০০ জন।
যুদ্ধের সাম্ভাব্য ভবিষ্যৎ
যুদ্ধের উত্তেজনা প্রতি নিয়তই চরম মাত্রার দিকে যাচ্ছে। বিশ্বনেতারা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে না হেটে পুনঃ পুনঃ বিভিন্ন আক্রমণের সামগ্রী দেওয়ার মাধ্যমে উস্কে দিচ্ছে যুদ্ধের তেজ। দীর্ঘ প্রায় আড়াই বছরের বেশি যুদ্ধের পর ক্লান্ত ইউক্রেনীয় সেনাদের যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যাবার খবর চাউর হচ্ছে বিভিন্ন মিডিয়াতে। পশ্চিমা দেশগুলোর অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবারাহের কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে আগ্রাসন বাড়াচ্ছে রাশিয়া। এদিকে ২০২৪ এ আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ী হবার পর ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ নিয়ে আমেরিকার দোদুল্যমান অবস্থা দেখা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় গত ৫ ডিসেম্বর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কি স্কাই নিউজকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে যুদ্ধ বন্ধের সমাধানে বলেন ইউক্রেনের যে অংশগুলো রাশিয়া দখল করে নিয়েছে তা রাশিয়া রেখে দিয়ে বাকি অংশ যা ইউক্রেনের অধীনে আছে তা ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলেই শুধুমাত্র এই যুদ্ধ বন্ধ করা সম্ভব। পরবর্তীতে রাশিয়ার অধীনে থাকা অংশগুলো কুটনৈতিক পন্থায় ফিরিয়ে নেয়া যাবে। কিন্তু রাশিয়া যেন আবার আক্রমণ করে বসতে না পারে তাই ইউক্রেনের বাকি অংশ ন্যাটোর ছায়াতলে নিয়ে আসতে চায় জেলেনেস্কি। ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট এর এই চাওয়া বর্তমান পরিস্থিতিতে অবান্তর ছাড়া আর কিছুই না। কারণ রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের মুখ্য কারণই ছিল ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার প্রচেষ্টা, সেখানে কোনোভাবেই ন্যাটোকে রাশিয়ার কাছাকাছি আসতে দিবে না পুতিন। এখন এ যুদ্ধের ব্যাপারে ট্রাম্পের ভূমিকা কি হয় সেটি দেখার অপেক্ষায় বিশ্ববাসী। ইউক্রেনে যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ন্যাটো সদস্য পদও দেয়া হবে না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়া হয়েছিল।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ভয়াবহতার সাক্ষী পৃথিবীর মানুষ। কেউই চায় না আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ। কিন্তু সম্ভবনা বাড়ছে তৃতীয় একটি বিশ্বযুদ্ধের। এই দফায় সহজ হবে না যুদ্ধ কারণ প্রায় ৯ টি দেশ বর্তমানে পারমানবিক শক্তির অধিকারী। জাপানের হিরোশিমার পারমানবিক হামলার রেশ আজও রয়ে গেছে সে অঞ্চলের মানুষের মাঝে। সত্যিই যদি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে বিশ্বে যুদ্ধ শুরু হয় আরেক দফা তবে হয়ত মানুষ জাতির অস্তিত্ব নিজ হাতেই শেষ হবে৷