বাংলার দুঃখ ‘ফারাক্কা বাঁধের’ আদ্যপান্ত

গঙ্গা হতে পদ্মা
গঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের কিছু পূর্বে তার প্রধান শাখা নদী ভাগীরথীর জন্ম দেয়। এরপর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকাসা ও দুর্লভপুর ইউনিয়ন দিয়ে ‘পদ্মা’ নাম ধারণ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। রাজশাহী শহরের পাশ দিয়ে বয়েে এসে নদীটি ইউসুফপুর ইউনিয়ন (শাহপুর) দিয়ে আমাদের চারঘাট উপজেলায় প্রবেশ করে।

ভারতের গঙ্গা থেকে বাংলাদেশে পদ্মার পথ ম্যাপে ; Image Source: Unsplash

ফারাক্কা বাঁধ
চাপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা নদীর ওপর অবস্থিত ফারাক্কা বাঁধ। এর দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ২৪ কিলোমিটার বা ৭ হাজার ৩শ ফুট। এটি শুধু একটি বাঁধ নয়, এই অবকাঠামোটি একটি সড়ক ও রেলসেতু হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। এই বাঁধের উপর দিয়ে গিয়েছে ৩৪নং জাতীয় সড়ক ও রেলপথ। বাঁধটিতে মোট ১০৯টি গেট রয়েছে। ফারাক্কা সুপার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানি এই বাঁধ থেকেই সরবরাহ করা হয়।

ফারাক্কা বাঁধ; Image Source: Google Earth

কলকাতা বন্দরে পালি জমে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ১৯৬১ সালে ভারত সরকার সোভিয়েত সরকারের সহায়তায় এই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। এই বাঁধের মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল পানির অভাবে হারিয়ে যেতে বসা গঙ্গার শাখানদী ভাগীরথীকে পুনরায় গঙ্গার পানিতে পূর্ণ করা এবং কলকাতা বন্দরকে আগের রূপে ফিরিয়ে এনে কার্যক্ষম করে তোলা। তৎকালীন হিন্দুস্তান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৎকালীন সোভিয়েন ইউনিয়নের সহায়তায় বাঁধটি তৈরি করে।

শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারি থেকে জুন) ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গার ৪০,০০০ ঘনফুট/সে পানি হুগলি নদীর দিকে চালিত করে। তৎকালীন বিভিন্ন সমীক্ষায় বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেন যে গঙ্গা/পদ্মার মত বিশাল নদীর গতি বাঁধ দিয়ে বিঘ্নিত করলে নদীর উজান এবং ভাটি উভয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হতে পারে। সকল নেতিবাচক অভিমত সত্ত্বেও ভারত সরকার ফারাক্কায় গঙ্গার উপর বাঁধ নির্মাণ ও হুগলী-ভাগরথীতে সংযোগ দেওয়ার জন্য ফিডার খাল খননের পরিকল্পনায় কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে যা মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার রাজ্যে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনে।

ফারাক্কা চুক্তি
গঙ্গার পানির এক অংশ ঘুরিয়ে হুগলী-ভাগরথীতে প্রবাহিত করে কীভাবে পলি অপসারণ করা যায় তার জন্য ১৮৫১ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল অবধি কমপক্ষে পাঁচটি সমীক্ষা করা হয়েছে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান এই বিষয় নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক আলোচনা করে। কিন্তু এই আলোচনা যখন চলছিল তখন ভারত ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণ কাজ অব্যহত রাখে এবং ১৯৭০ সালে এর কাজ শেষ করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার গঙ্গার পানিবন্টন গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানিবন্টন বিষয়ে এক যৌথ বিবৃতি দেন। এই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, উভয় দেশ একটি চুক্তিতে আসার আগে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করবে না। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সালে ভারতকে বাঁধের একটি অংশ পরীক্ষা করার জন্য মাত্র ১০ দিনের (২১ এপ্রিল ১৯৭৫ থেকে ২১ মে ১৯৭৫) জন্য গঙ্গা নদীর ৩১০ থেকে ৪৫০ কিউসেক পানি অপসারণ করার অনুমতি দেয়। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পর ভারত কোনোরকম আলোচনায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসুম পর্যন্ত গঙ্গা নদী থেকে ১১৩০ কিউসেক পানি অপসারণ করে পশ্চিমবঙ্গের ভাগরথি-হুগলি নদীতে প্রবাহিত করে। ভারতকে পানি অপসারণে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়ে, বাংলাদেশ এই বিষয়টি জাতিসংঘে উপস্থাপন করে। বাংলাদেশের সঙ্গে করা ভারতের এ ধরনের অন্যায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আলোচনা করা হলেও বিষয়টি ভারত খুব একটা পরোয়া করেনি।

চুক্তির উদ্দেশ্য
গঙ্গা চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল শুষ্ক মৌসুমে প্রতি বছর ১লা জানুয়ারি থেকে ৩১শে মে পর্যন্ত ১০ দিনের চক্র করে দুই দেশ পানি ন্যায্যভাবে ভাগ করে নেবে।

পানি ভাগাভাগি হয় যেভাবে
বাংলাদেশ ও ভারত যার যার ন্যায্য হিস্যা পেল কিনা সেটা এই জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে দুই দেশের নদী কমিশনের পর্যবেক্ষণ দল। বাংলাদেশে কী পরিমাণ পানি প্রবেশ করছে বা সরে যাচ্ছে সেটা পরিমাপ করা হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে। অন্যদিকে ভারতের অংশে দৈনিক পানির প্রবাহ পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করা হয় ফারাক্কা ব্যারেজের নীচে, ফিডার ক্যানেলে এবং ন্যাভিগেশন লকে।
জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত অর্থাৎ বর্ষা মৌসুম জুড়ে পানি কী পরিমাণ আটকে রাখা হবে বা ছাড়া হবে সেটা নির্ভর করে ভারতের অংশে গড় বৃষ্টিপাত ও নদীর পানি প্রবাহের ওপর। ফারাক্কা বাঁধের সামনে যে পন্ড থাকে, সেখানে পানির উচ্চতা মাপার জন্য একটি রেকর্ডিং লেভেল থাকে যেটি পর্যন্ত পানি ধরে রাখলে বাঁধের কোন ক্ষতি হবে না। পানি ওই সীমানা অতিক্রম করলেই ভারত ফারাক্কা বাঁধের গেটগুলো একে একে খুলে দিয়ে পানি ছাড়তে থাকে। না হলে পুরো বাঁধ পানির তোড়ে ভেসে যাবে। বাংলাদেশ যেহেতু ভাটির দেশ তাই সমুদ্রে যাওয়ার আগে সেই পানির ধাক্কাটা এ দেশের ওপর দিয়ে যায়। এরপর নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে পন্ডে পানির লেভেল অনুযায়ী পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

বর্ষায় খোলা হয় ফারাক্কার গেইট; Image Source: Pexels

ফারাক্কা বাঁধের ক্ষতিকর প্রভাব
গত চার দশকেরও বেশি সময়ে এই বাঁধ গঙ্গা অববাহিকায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে যার কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছে দুই দেশই।
১. শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অপসারণের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে বাংলাদেশকে কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌ পরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়। প্রত্যক্ষ ভাবে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়; যদি পরোক্ষ হিসাব করা হয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে।
২. এক সময় পদ্মার নদীপথে অসংখ্য ছোটবড় জাহাজ এবং মাছধরার নৌকা দিনরাত চলতো । কিন্তু এখন শুষ্ক মৌসুমে প্রায় সাড়ে তিনশো’ কিলোমিটারের বেশি নৌপথ বন্ধ রাখতে হয়।
৩. ভারতের বিহার ও উত্তরপ্রদেশে প্রতিবছর বন্যা ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ফারাক্কা বাঁধ সরিয়ে স্থায়ী সমাধান চেয়ে আসছেন। একই দাবি বাংলাদেশের পরিবেশবাদীদেরও। কেননা এই বাঁধের কারণে বর্ষার মৌসুমে বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমের বেশ কিছু জেলাও বন্যা ও নদী ভাঙনের কবলে পড়ে।
৪. বাঁধের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে কৃষিজমি, মৎস্য চাষ, নৌপরিবহন সর্বোপরি আবহাওয়ার ওপর। যা পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনছে।
৫. পদ্মায় প্রয়োজনীয় প্রবাহ না থাকার কারণে তার প্রভাবে ছড়িয়ে পড়ছে লবণাক্ততাও।
৬. শুষ্ক মওসুমে পানি প্রবাহ কম হওয়ার কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন দেখা দেয়।
তৎকালীন ভারতের পশ্চিম বঙ্গের তদানীন্তন চীফ ইঞ্জিনিয়ার শ্রী কপিল ভট্টাচার্য এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে মতামত ছিল যে গঙ্গা থেকে অপসারিত ৪০ হাজার কিউসেক পানি ফিডার খাল কিম্বা হুগলী-ভাগরথী ধারণ করতে পারবে না। গঙ্গা এবং ভাগরথীর প্রবাহ রেখার উচ্চতার তারতম্যের কারণে পানি সঞ্চালন কষ্টকর হবে। ফলে গঙ্গা নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য অন্য পথ খুঁজবে। প্রথমোক্ত কারণের জন্য মুর্শিদাবাদ এবং মালদা জেলা জুড়ে দেখা দিবে জলাবদ্ধতা।

বাংলার দুঃখ
গঙ্গার উপর ভারতের নির্মিত এই বাঁধ বাংলাদেশের প্রাণ ও প্রকৃতির উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এ দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য করাল গ্রাস রুপী এই বাঁধ তাই এ দেশের মানুষের কাছে মরণ ফাঁদ হিসেবে পরিচিত। বর্ষার সময় অতিরিক্ত পানির চাপে ভারত সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বাঁধের গেট খুলে দেয়, যা বাংলাদেশের নদীগুলোতে তখন অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হয়। ফলে নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়ে অকস্মাৎ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ফারাক্কা বাঁধের কারণে রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চল প্রায় মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ফারাক্কার কারণে পদ্মায় বছরের প্রায় ৮ মাসই পানি থাকে না। এ বাঁধের কারণে পদ্মা নদী রাজশাহী শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে সরে গেছে। গ্রীষ্মে মানুষ পানির তীব্র অভাবে ভোগে। এছাড়াও এর ফলে তৈরী হওয়া জলবায়ুর বিরুপ পরিবর্তন দেশের জন্য অশনী সংকেত। বাংলার মানুষ আশা রাখে উপযুক্ত পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে একদিন অবশ্যই নিজের ন্যায্য অধিকার আদায় করে নিতে পারবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top