আচ্ছা ধরুন হঠাৎ করেই ফেইসবুক খুলে দেখলেন এক বিখ্যাত পলিটিক্যাল পার্টির নেতা ভিডিওতে বলছে তাদের পার্টিতে ভোট না দিয়ে বিপক্ষ পার্টিকে ভোট দিতে!!! কিংবা খুব সেনসেটিভ একটা ষড়যন্ত্রের অডিও ফাস হয়ে গেল হাই লেভেলের কোনো নেতার কন্ঠে। কি? মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে তো? একটা বার চিন্তা করে দেখুন তো সে নেতার প্রতি কেমন ভীষণ নেগেটিভ ধারণাটাই না জন্মাবে । কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই যদি হয় এ আইয়ের কারসাজি তাহলে?
শিক্ষা, চিকিৎসা কিংবা চাকরি, এ আইয়ের ধাক্কা লাগে নি এমন কোনো সেক্টর বাকি নেই। আশংকা করা হচ্ছে, এই ধাক্কা এবার ধেয়ে আসছে দেশের সবচেয়ে বড় সেন্সেটিভ ইস্যু নির্বাচনকে টার্গেট করে। প্রযুক্তির ছোয়া ছাড়াই যে নির্বাচনকে সবসময় ঘিরে থাকে দাঙ্গা, হাঙ্গামা, অস্থিরতা আর নিরাপত্তাহীনতার মত ইস্যু, একুশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় অস্ত্র এআইয়ের বিপরীতে লড়াই করে সে নির্বাচনে গণতন্ত্র ঠিকঠাক টিকে থাকতে পারবে তো?
পোস্টারে প্রচার প্রচারণা থেকে নিউজফিডে পাতায় জনমত গড়ার রাস্তায় এখন নির্বাচনের রঙ পাল্টেছে অনেক খানি। একটা সময়ে মাইকিং আর রাস্তায় পোস্টার, ব্যানারে রাজনৈতিক দলগুলোর ঢাক ঢোল পেটানো হত। সেদিন অনেক আগেই চলে গেছে। এখন শুধু মাঠের রাজনীতি করলেই হয় না, রাজনীতির ভোল যে কোন সময়ে পাল্টে যেতে পারে ইন্টারনেটে ভাইরাল হওয়া ন্যারেটিভে।
আর ন্যারেটিভ সেট করার সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্র যেটার জন্য কোনো লাইসেন্স লাগছে না, পারমিশন লাগছে না, তোয়াক্কা করতে হচ্ছে না কোনো নিয়ম নীতির সেটার নাম হচ্ছে এআই। গত কয়েক বছরের প্রতিটা দিনে গুটি গুটি পায়ে এআই দিনকে দিন আরো পারফেক্ট হচ্ছে। একটা সময়ে এআই এ বানানো ছবি বা ভিডিওতে বাস্তবের সাথে কিছু পার্থক্য থাকায় চোখের দেখাতেই আলাদা করে ফেলা যেত। আজকাল অনেক্টুকু ইম্প্রুভ হয়ে যাওয়া এ আইকে দেখে নিজেরই বুঝতে কষ্ট হয়ে যায় যা দেখছি সেটা কি সত্যি নাকি ইল্যুশন। ডিপফেক ছবি, ভিডিও, ক্লোন করা অডিও যেখানে দাপুটে, শিক্ষিত মানুষদেরকেই সন্দেহে ফেলে দিতে পারে সেখানে সাধারণ মানুষ কিংবা আমাদের বাবা মায়ের মত পুরানো জেনারেশনের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
এই যেমন শেখ হাসিনার কথাই ধরুন। দুদিন পরপর তার কল রেকর্ড ফাস হচ্ছে, মরে যাওয়ার ছবি পর্যন্ত ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে অথচ পরেরদিনই দিব্যি ইন্টারন্যাশনাল নিউজ মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার দিয়ে দিল সে। নির্বাচনের আগে এই ধরনের রাজনৈতিক ভুয়া নিউজগুলো দেশের নিরাপত্তার উপর চরম হুমকি হয়ে উঠতে পারে। কারণ নির্বাচনের মাঠে একটা প্রার্থীর রেপুটেশনই তার ভাগ্য নির্ধারণ করে দিতে পারে। যেটা বর্তমান সময়ে অবিশ্বাস্য রকমের কঠিন।
এ আই একটা নির্বাচনের সাম্ভাব্য ফলাফল কেমন উলটে পালটে দিতে পারে ২০২৪ সালেই পুরো দুনিয়া জুড়ে সেটার অসংখ্য প্রমাণ পেয়েছে মানুষ । কারণ সে বছরটায় সারা বিশ্বে চলেছে নির্বাচনের সুপার সাইক্লোন। ৭০ টারও বেশি দেশে সে বছর জাতীয় নির্বাচন হয়েছিল। মানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৪% ভোটাভুটিতে অংশ নিয়েছিল। এমন সেনসিটিভ সময়ে সারা বিশ্বে একের পর এক টুইটার, টিকটক ফেইসবুকের মত প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে এ আই নিয়ে ভয়ংকর জুয়া খেলা হয়েছে।
ছোট দেশগুলো তো পরের কথা স্বয়ং আমেরিকার নির্বাচন রক্ষা পায় নি এআইয়ের এবিউসিভ ব্যবহার থেকে। ২০২৪ সালের ২৩ শে জানুয়ারি আমেরিকার নিউ হ্যাম্পশায়ার প্রদেশে ছিল প্রাথমিক (প্রাইমারি) নির্বাচন। বছরের শেষে নভেম্বরে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে কে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তা চূড়ান্ত করতেই ছিল এই নির্বাচন। ঠিক তার দু’দিন আগে নিউ হ্যাম্পশায়ারের ভোটারদের ফোনে আসে একটি ভয়েস কল। কলে জো বাইডেনের কন্ঠে বলা হচ্ছিল ভোট না দেওয়ার জন্য। হাজার হাজার মানুষের কাছে চলে গিয়েছিল কলটি। ভয়ংকর ব্যাপার হল অডিও কলটা পাওয়ার পরে অনেকেই আর ভোটই দেয় নাই। পরবর্তীতে বোঝা যায় পুরো ব্যাপারটা ছিল এ আই দিয়ে ভয়েস ক্লোন করে বানানো।
আবার নির্বাচনি প্রচার চলাকালে ট্রাম্প এআই দিয়ে তৈরি ছবি পোস্ট করেন, যেখানে দেখা যায় বিখ্যাত মার্কিন সঙ্গীতশিল্পী টেইলর সুইফট ট্রাম্পের জন্য প্রচারণা চালাচ্ছেন। অথচ টেইলর সুইফট ছিল প্রকাশ্যে একজন কমলা হ্যারিস সমর্থক।
শুধু আমেরিকা না, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্লোভাকিয়ার নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছিল এ আই কতটা ম্যানিপুলেটিং হতে পারে। দেশটির নির্বাচনের ঠিক দুইদিন আগে একটি অডিও রেকর্ডিং ভাইরাল হয় ফেসবুকে। যেখানে শোনা যায় ন্যাটোপন্থী প্রোগ্রেসিভ স্লোভাকিয়া পার্টির শীর্ষ নেতা মিশাল সিমেস্কা আর সাংবাদিক মোনিকা তোদোভা আলোচনা করছেন কীভাবে ভোটে কারচুপি করতে হয়। এনালাইসিস করে দেখা গেল অডিও ক্লিপটি এআই দিয়ে বানানো। কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হবার হয়ে গেল। মানুষের অবিশ্বাসের কাছে হেরে গেল প্রোগ্রেসিভ স্লোভাকিয়া পার্টি।
এভাবে নাইজেরিয়ার নির্বাচনেও ছিল এ আই দিয়ে বানানো ফেইক ছবি, ভিডিওর ছড়াছড়ি। আর্জেন্টিনার নির্বাচনে তো দুই বিরোধী দল এত পরিমাণে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে একে অন্যের পলিটিকাল রেপুটেশন বরবাদ করার চেষ্টা করেছে যে ইন্টারন্যাশনাল নিউজ মিডিয়াগুলো তাদের নির্বাচনের নাম দিয়েছে “এআই নির্বাচন “।
এই তো পাশের দেশ ভারতেও এআই নিয়ে কম ভোগান্তি হয় নি। ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে প্রায় ৬ কোটি ডলারের বাজার হয়ে উঠেছিল ডিপফেকের। জনপ্রিয় নায়ক নায়িকাদের ফ্যানবেজকে ম্যানিপুলেট করতে এআই ভিডিও ব্যবহার করে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে ও বিপক্ষে চালানো হয় প্রচারণা। এমনকি এআই জেনারেটেড ভয়েজ ব্যবহার করে ভোটারদের কল দেয়া হয় ৫ কোটি বারের বেশি। তামিলনাড়ুতে জনপ্রিয় নেতার ছবির ডিপফেইক ভিডিও বানিয়ে নিজ দলের পক্ষে জনমত বাড়ানো কিংবা ভোটারদের সহানুভূতি পাবার চেষ্টা করা হয়েছিল অথচ সে নেতা মারা গেছে ২০১৮ সালেই। বাংলাদেশেও ২০২৪ সালের নির্বাচনে এআইয়ের মিথ্যা ভিডিওর শিকার হয়েছিল দুইজন প্রার্থী। মোদ্দা কথা হল এআইয়ের ডার্ক সাইড থেকে গা বাচাতে পারে নি কোনো দেশের নির্বাচনই।
মেটা, ওপেনআই এর মত প্রতিষ্ঠানগুলো এআইকে যতই ইনোসেন্ট, ওয়েল কন্ট্রোলড দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন এআইকে এ পর্যন্ত বিশ্বের কোনো দেশের নির্বাচনে ১০০% নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় নাই। তবে এআইয়ের কিছু যে ভালো দিক আছে তা মানছি।
যেমন এআইয়ের মাধ্যমে ভোটার তালিকা যাচাই আরও দ্রুত আর নির্ভুল হতে পারে। ভুয়া ভোটার শনাক্ত, ডুপ্লিকেট নাম মুছে ফেলা সবই সম্ভব স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এছাড়া ভোটারদের কাছে তথ্য পৌঁছে দিতে মানে ভোটের দিন ও কেন্দ্র সম্পর্কে জানানোর জন্য এআই চ্যাটবট ব্যবহার করে কাজ হাজার গুণ সহজ করা সম্ভব।
কিন্তু সত্যি বলতে এআইয়ের ক্ষতিকর দিকের তুলনায় ভালো দিকটা একদমই হাতে গোণা। নির্বাচনের মাঠে এ আই একটা “হাইপার টার্গেটিং” অস্ত্র। মানুষের ইমোশনের জায়গাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ডিপফেইক ভিডিও বানিয়ে, অডিও ক্লোন করে মিথ্যা অডিও ক্লিপ কিংবা এ আই জেনারেটেড ভুয়া ছবি ছড়িয়ে দেয়া এখন পানির মত সহজ। সমস্যা হচ্ছে এসব ছবি, অডিও, ভিডিওর অনেকগুলোতেই এআই লোগো থাকে না। ফলাফল সহজেই মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে যায়। মানুষের ডাটা এখন এআইয়ের কাছে ওপেন সিক্রেট। এসব ডাটাকে এনালাইসিস করে মানুষের সেন্টিমেন্ট পয়েন্ট খুজে বের করা হয়। তারপর এ আই দিয়ে সেরকম ট্রেন্ড শুরু করা বা কন্টেন্ট বানিয়ে মাইক্রো টার্গেট করা হয় ভোটারদের। আর এভাবে আগ থেকেই নির্বাচনের দ্বন্দের আগুনে ঘি ঢালার কাজটা করে দেয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। মানুষকে বিভ্রান্ত করে ভুল সিদ্ধান্ত, মব কালচারকে আরও উসকে দেয়।
বাংলাদেশের জন্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের এই রুপটা হতে পারে ভয়াবহ সেনসিটিভ। এদেশের প্রায় ৮ কোটিও বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এদের মাঝে আবার শতকরা ৭০ জনই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটিভ। এসব সোশ্যাল মিডিয়াতে ঢুকলেই দেখা যায় মানুষ এখন নিজেই সাংবাদিক, বিশ্লেষক, আইন প্রণেতা। অভিযোগ দিচ্ছেন যিনি, ওকালতিও করছেন তিনি, শেষে বিচারক হয়ে রায়টাও দিয়ে দিচ্ছেন একই মানুষ। এর জন্য আর আইন, আদালত, সত্য মিথ্যার ভেরিফিকেশন লাগছে না। এসব আবার হাজার হাজার মানুষ শেয়ার করে ছড়িয়ে দিচ্ছে মুহূর্তেই।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বিষয়টা কিন্তু ঠিকই মাথায় রেখেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা থেকে শুরু করে দাঙ্গা হাঙ্গামা তৈরি করা, দেশি বিদেশি চক্রান্তের হাইপার টার্গেটিং সবকিছুর মূলে আছে এ আই। এটাই এখন তাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কথা হচ্ছে বাংলাদেশের নেক্সট নির্বাচনকে সামনে রেখে এআইয়ের অপপ্রচারকে বাধা দিতে কতটা প্রস্তুত নির্বাচন কমিশন? কি কি স্টেপ নেয়া হয়েছে?
এছাড়াও নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অপপ্রচার, মিথ্যাচার বা অপবাদ ছড়ালে প্রার্থী, রাজনৈতিক দল, প্রতিষ্ঠান বা গণমাধ্যম সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেটা কিভাবে বলছি৷
রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর নির্বাচনি আচরণ বিধিমালায় সংযোজন করা হয়েছে ১৬ নাম্বার বিধি। সেখানে বলা আছে কোনো প্রার্থী বা তার নির্বাচনি এজেন্ট বা প্রার্থীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণা পরিচালনা করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে- প্রার্থী বা তার নির্বাচনি এজেন্ট বা দল বা প্রার্থী সংশ্লিষ্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নাম, অ্যাকাউন্ট আইডি, ই-মেইল আইডিসহ অন্যান্য সনাক্তকরণ তথ্যাদি প্রচার-প্রচারণা শুরুর পূর্বে রিটার্নিং অফিসারের নিকট দাখিল করতে হবে। এরপর যদি অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো প্রার্থী, তার এজেন্ট বা প্রার্থীর বিপক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোনো মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মানে এআই ব্যবহার করে তাহলে তার প্রার্থিতা বাতিল করে দেবে ইসি। একই সঙ্গে হতে পারে জেল জরিমানা।
আইন হয়েছে ঠিকই কিন্তু আইনটা হয়েছে শুধু প্রার্থী বা তার দলের জন্য। কিন্তু এর বাইরের অন্য মানুষের অপপ্রচার ঠেকানো হবেটা কিভাবে? মাথায় রাখতে হবে, দেশের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেশি চক্রের সাথে সমান তালে আতাত চলছে বিদেশি চক্রেরও। পান থেকে চুন খসলেই তাই ঘুরে যেতে পারে নির্বাচনের ডায়নামিক্স। এদিকে ইসির নিজস্ব কোনো নির্বাচনী সাইবার সিকিউরিটি সেল, শাখা বা ইউনিট নেই। অথচ ভুয়া তথ্যকে ফিল্টার করতে এখন সরকারের নিজস্ব একটা ফ্যাক্ট চেকিং ও মনিটরিং সেলের খুবই প্রয়োজন।
মিসইনফরমেশন যে চাইলেই পুরোপুরি ঠেকানো যাবে না এটা জানা কথা। কিন্তু চাইলে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা অসম্ভব কিছু না। মনিটরিং সেলগুলো বানানো এখন সময়ের দাবি। ২৪ ঘন্টা যদি ফ্যাক্ট চেকিং প্রসেস চলমান থাকে তাহলে গভীর রাতের মিসইনফরমেশনও সাথে সাথে প্রতিহত করা যাবে। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঠেকাতে ভুয়া ন্যারেটিভ মেকারদের সঠিক সময়ে থামাতেই হবে। নয়তো এআই নামক ম্যানিপুলেশনের কাছে জিম্মি হয়ে যাবে আপনার আমার গণতন্ত্র।




