ধর্ষণের কালো ছায়া: এর শেষ কোথায়?

একাত্তরের সম্ভ্রম হারানো নারীকে দেশ বীরাঙ্গনা উপাধি দিল, আর ২১ শতকের সম্ভ্রম হারানো নারীকে আমরা ধর্ষিতার ট্যাগ লাগিয়ে দি৷ 

বিগত কয়েক মাস ধরেই দেশে আশংকাজনক হারে বেড়েছে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আরেকটি মরণ ব্যাধি। “ধর্ষণ”। 

রাজনীতির প্রেক্ষাপট পালটায়। কত হাতি ঘোড়া অদল বদল হয়, শুধু পরিবর্তন হয় না দেশের সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতনের চিত্রের। দেশটা যেন মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে। সবার মনেই প্রশ্ন কেন বাড়ছে প্রতিনিয়ত  ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতি? এর পেছনের মোটিভই বা কি? পরিসংখ্যান কি বলে? হঠাৎ করেই কি এটা মহামারী আকারে বেড়েছে গেছে? নাকি আগ থেকেই চলছে এই অপরাধ প্রবণতা কিন্তু আমাদের তেমন কনসার্ন ছিল না? প্রসাশনই বা কি করছে? আইন শৃঙ্খলার এমন অবনতি আমাদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে? আজ আমরা জানব সব প্রশ্নের উত্তর।

সাম্প্রতিক

১৭ ফেব্রুয়ারি। রাত ১২ টা বেজে ৩৫। ঢাকার গাবতলি থেকে রাজশাহী রুটের বাস ইউনিক রোড রয়েলস যাত্রা শুরু পর কিছুদূর গিয়েই  ৫/৬ জনের মত লোক নেয়। বাসটি তখন গাজীপুরের চন্দ্রায়। গাড়ির ভেতরে যাত্রীর ছদ্মবেশে থাকা ৩ জন আর বাইরে থেকে ওঠা ৫/৬ জন মিলে হামলে পড়ে বাসের ঘুমন্ত যাত্রীদের উপর । যার যা কিছু আছে সবকিছু নিয়ে তো নিলই আর গাড়ির দুইজন মহিলা যাত্রীর শ্লীলতাহানি করতে ছাড়ল না। কয়েকজন যাত্রীর মতে নারী দুজনকে ধর্ষণ করা হয়। তবে যাই হোক না কেন শারীরিক নির্যাতন যে হয়েছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 

এর কিছু দিন আগ থেকেই প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ধর্ষণের প্রতিবেদন জায়গা করে নিচ্ছিল সংবাদমাধ্যম গুলোর হেডলাইনে। এবার আর থেমে থাকতে পারে নি সাধারণ মানুষ। প্রশাসন ও বিচার ব্যাবস্থার প্রতি তাই আক্রোশ ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। কেন একের পর এক নির্যাতিত হচ্ছে আমাদের বোনেরা? রাতের অন্ধকার হোক কিংবা দিনের আলো, বাসায় কিংবা রাস্তায় কোথাও নিরাপদে নেই মেয়েরা। কেন রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে? এ নিয়ে প্রতিবাদ যখন চলমান তার মাঝেই গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বনশ্রী এলাকাতে ৫/৬ জন মিলে এক ব্যবসায়ীকে ছিনতাই করে ২০০ ভরি স্বর্ণ ও ১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। ঘটনার ভয়ংকর অংশ হচ্ছে তাকে চার রাউন্ড গুলি করে দুষ্কৃতিকারীরা। এতদিন রাম দা,  চাইনিজ কুড়াল, ছুরি দিয়ে ছিনতাই দেখেছে মানুষ। এখন যোগ হল বন্দুকও! প্রচন্ড আতঙ্কে দিন কাটছে এখন দেশবাসীর। নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা তলানিতে ঠেকলে  দিনের বেলাও মানুষ বের হতে ভয় পায়?  জীবনের নিরাপত্তা যেখানে নেই সেখানে সংস্কারের বুলি যেন বিলাশিতা। 

আইন শৃঙ্খলা অবনতির নেপথ্যে কি

রাজনৈতিক শক্তি যখন ক্ষমতায় থাকে তখন তার অপব্যবহার করতে উঠে পড়ে লাগে কিছু মানুষ তা বুঝলাম কিন্তু অন্তর্বতী সরকারের সময়ে কেন এত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে? কাদের দৌরাত্ম বাড়ছে এখন? এর নেপথ্যে কি রাজনীতির ষড়যন্ত্র নাকি অন্য কিছু? 

কেন হচ্ছে অপরাধ

না বর্তমানে দুই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কেউই ক্ষমতায় নেই। গত বছরের অগাস্ট মাসে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাবার পর প্রায় ১৭ বছর ধরে পঙ্গু করে রাখা দেশটি এখনো দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নানারুপ ষড়যন্ত্রের কাটা দেশের মানুষকে বিদ্ধ করছে প্রতিনিয়ত। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে সামাজিক অবক্ষয় জেঁকে বসেছে মারাত্মক ভাবে। কি ভাবছেন?  রাজনীতির অস্থিতিশীলতার সাথে সামাজিক অবক্ষয়ের যোগসূত্র কোথায়? বুঝিয়ে বলছি। জুলাইয়ের আন্দোলনে আমরা সবাই দেখেছি কিভাবে সমাজ রক্ষক পুলিশ, র্যাব, অন্যান্য ফোর্সগুলো সমাজের ভক্ষকে পরিণত হয়েছিল। আন্দোলন শেষে মানুষের তীব্র ক্ষোভের শিকার হল পুলিশ, বিশ্বস্ততা উঠে গেল র্যাব ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর থেকে। প্রকাশ হতে থাকল একের পর এক নিরাপত্তা বাহিনীর দুর্নীতি, অপকর্ম। যে রক্ষা করবে সেই যদি অপকর্মে জড়িয়ে যায় তাতে আইন শৃঙ্খলার ভাঙন তো আসবেই। দেশ স্বাধীনের কেবল ছয় মাসের মধ্যেই আইনের শাসনের প্রয়োগের অভাবে দেশে ঘাপটি মেরে থাকা ছোট, বড় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। প্রকাশ্যে চুরি, ছিনতাই তো অহরহ দেখছে দেশবাসী৷ তারওপর যোগ হয়েছে ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধ। এসব অপরাধ শুধু দাগী সন্ত্রাসীরা করছে না, আইনের শিথিলতায় অনেকে নতুনভাবেও যুক্ত হচ্ছে অপরাধে। 

রাজশাহী গামী বাসের যে দুইজন আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা দুইজনই স্বীকার করেছে তাদের জীবনের প্রথম ডাকাতি এটা।  

অন্তর্বর্তী সরকার এসে ঢাকা মহানগর পুলিশের মাঠপর্যায়ে ব্যাপক রদবদল করে। এখন ঢাকার থানাগুলোতে পুলিশের বড় অংশই ঢাকার বাইরে থেকে আসা। তারা রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলির রাজনীতির সাথে পরিচিত না৷ এ ছাড়া রাজধানীতে তাদের সোর্সও এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাই বেগ পেতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু প্রশ্ন হল আইন ভাঙার এত সাহস কিভাবে হয় অপরাধীদের? কিভাবে ডাকাতি আর ধর্ষণের মত অপরাধ ঘটছে এত সহজে? প্রকাশ্যে রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গার্মেন্টস কর্মী বা স্কুল শিক্ষার্থীকে, কুপিয়ে ছিনতাই করছে দিনে দুপুরে। এদের শাস্তির কি কোনো ভয়ডর নেই? 

তা নেই বটে। চলুন দেখি সন্ত্রাসীরা পাখা গজিয়ে ওঠার জায়গাটুকু পেয়েছে কিভাবে? 

কিভাবে

২০১৬ সালের ২০ মার্চ। তনু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় তখন সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ চাঞ্চল্যকর এই ধর্ষণ ঘটনার আপডেট কি জানেন? নয়টা বছর হয়ে গেল। এখনও আসামী নাকি অজ্ঞাত! হত্যার পরপরই সব আলামত মুছে ফেলা হয়েছে। আচ্ছা আসামি তো দূরে থাকুক তনুর বাবার সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের জিজ্ঞেসাবাদ পর্যন্ত করা হয় নি। চিন্তা করে দেখুন অবস্থাটা! 

কিংবা ২০২০ সালে নোয়াখালীতে নির্মমভাবে গণধর্ষণের শিকার হওয়া নারীর ঘটনাই দেখুন। ধর্ষকরা আজ জামিনে মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুটি ঘটনাই সে সময় আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মধ্যে। প্রতিবাদ, মিছিল, সমাবেশ কোনটা বাদ রাখে নি আপামর জনতা। ঘটনাগুলো মানুষের মাঝে তথাকথিত “ভাইরাল” হয়ে যাওয়ায় প্রশাসন মামলা নিয়েছিল ঠিকই, বিচার পাওয়ার আশ্বাসও দিয়েছিল। আজ পেছনে তাকালে দেখবেন সব মিথ্যে ছিল। 

বাংলাদেশের আইন

চলুন দেখি বাংলাদেশের আইন কি বলে ডাকাত, ছিনতাইকারী ও ধর্ষণকারীর শাস্তি সম্পর্কে। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধর্ষণ ও ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যুর শাস্তি ইত্যাদি প্রসঙ্গে ৯(১) ধারা মতে বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা দল বেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় নারী বা শিশুর মৃত্যু বা আহত হলে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান ছিল মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। উভয় ক্ষেত্রে ন্যূনতম এক লক্ষ টাকা জরিমানার বিধানও রয়েছে। সে আইনটিতে পরিবর্তন এনে ২০২০ সালে প্রবল প্রতিবাদের মুখে ধর্ষণ প্রমাণিত হলেই মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। সেই সাথে অর্থদণ্ডের বিধান তো থাকছেই। আর অধ্যাদেশে মামলার বিচার শেষ করতে ছয় মাস বা ১৮০ দিনের সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। 

আর ৩৯৫ ধারার বিধান অনুযায়ী ছিনতাই বা ডাকাতির শাস্তি হচ্ছে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা দশ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও অর্থদন্ড। 

লুপহোল

সিস্টেম তৈরি করে একদল মানুষ আর এর ফাঁকফোকর বের করতেও সময় লাগে না আরেক দল মানুষের। সন্ত্রাসীদের পাখা গজিয়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছে এই সিস্টেমই। ধর্ষণের আইন তো আছেই কিন্তু একটা ঘটনারও শেষতক কঠিন কোনো রায় সচরাচর কেন শুনতে পাই না আমরা? গলদটা কোথায়? জ্বী, গলদটা কিন্তু গোড়াতেই। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০১৩ অনুসারে ট্রাইব্যুনাল ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার কাজ শেষ করবেন। কিন্তু ১৮০ দিন সময় বেঁধে দিলেও মধ্যে বিচার কাজ শেষ না হলে কি হবে তার উল্লেখ না থাকায় আইনজীবীরা এর সুযোগ নিত।ফলে দফায় দফায় মামলার তারিখ পরে আর পিছিয়ে যায়।  ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিমকোর্টের জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, ট্রাইব্যুনাল যদি ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হয় তাহলে কারণ সংবলিত প্রতিবেদন ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিমকোর্টে দাখিল করবেন। তবে এমন নজির খুব একটা নেই। বেশিরভাগ মামলা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হয় না। সুপ্রিমকোর্টের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বিচারাধীন মামলা দেড় লাখের বেশি। সেগুলোর মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় বিচারাধীন ২৫ শতাংশ মামলা। এর বাইরেও উচ্চ আদালতের আদেশে হাজার খানেক মামলার বিচার স্থগিত আছে। 

এছাড়াও আগে আদালতে কেউ সাক্ষ্য দিতে এলে সরকারিভাবে তার যাতায়াত ভাড়া সহ নির্দিষ্ট পরিমাণ খরচ দেয়া হতো কিন্তু এখন সে টাকাটাও প্রদান করা বন্ধ হয়ে গেছে। যাতায়াত খরচ দেওয়ার কারণে আদালতের সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে উৎসাহিত হতো। এখন খরচ নিজেদের দিতে হয় তাই সাক্ষী নিজেও আসতে চায় না। 

মামলা নিষ্ফল হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হল মামলার সাক্ষীর নিরাপত্তাহীনতা৷ আসামিপক্ষ বেশির ভাগ সময়ই ক্ষমতাসীন বা রাজনৈতিক প্রভাবশালী হওয়ায় জোরপূর্বক মামলা নিষ্পত্তি করতে চায়৷ মামলার সাক্ষীকে খুন, গুমের হুমকি ধামকি, তার পরিবারের সদস্যদের ক্ষতি করার চেষ্টা এসব তো আছেই। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মামলার সাক্ষীরা যথাযথ নিরাপত্তা না পাওয়ায় নিজের জীবনের ও পরিবারের কথা ভেবে সরে দাঁড়ায় মামলা মোকদ্দমা থেকে। 

ধর্ষণের জন্য আসামীকে কিছুটা ঝাক্কি পোহাতে হলেও ছিনতাই, ডাকাতির ক্ষেত্রে আইনের চোখে ধুলো দেয়া যেন ডালভাত। ছিনতাইকারী এসব চক্রের সদস্যদের রয়েছে নির্ধারিত আইনজীবী। তাই জামিনও সহজেই হয়ে যায়! এ ছাড়া আদালতও কিশোর অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে জামিন দিয়ে দেন। কেন লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না অপরাধীদের বুঝতেই পারছেন নিশ্চয়ই। 

আইনের ফাঁক ফোকর এতই যে ভিকটিম আইনের দ্বারস্থ হওয়ার আগ্রহই হারিয়ে ফেলে। জরিপ অনুযায়ী, দেশে যে পরিমাণ যৌন হয়রানি ও নির্যাতন হয় তার মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ বিচারের আওতায় আসে। তারপরও তারা বিচার পান না। আইনকে স্বাধীনভাবে চলতে না দিলে ঠিক এই পরিস্থিতি হয়৷ আইন থাকে, কিন্তু বিচার হয় না৷ তবে অপরাধ কমাতে চাইলে বুঝতে হবে অপরাধীর প্যাটার্নটা কি? কারা ঘটাচ্ছে এসব? 

কারা করছে এসব

সম্প্রতি ক্লাস এইটে পড়ুয়া ছোট্ট মেয়েকে হাত পা বেধে ৫ জন মিলে ধর্ষণ ও নৃশংসভাবে হত্যা করে লাশ হাতিরঝিলে ফেলে পালিয়ে যায়। আসামিদের তথ্য মতে ধর্ষণের সাথে জড়িত পাঁচ জনই কোন না কোন অপরাধের সাথে জড়িত ছিল। প্যাটার্নটা খেয়াল করুন। প্রত্যকেরই আছে পূর্বে অপরাধ করার ট্রেক রেকর্ড। 

নিউমার্কেট ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় নিয়মিত ছিনতাইকারী মোহাম্মদ সেলিমের ঘটনাই শুনুন। তার নামে ঢাকার বিভিন্ন থানায় অন্তত ১১টি মামলা রয়েছে। প্রথমবার জামিনে বেরিয়ে ফের শুরু করে ছিনতাই। পরে আরও ১০ বার গ্রেপ্তার হয়, তবে প্রতিবারই জামিনে বেরিয়েছে এবং যথারীতি জড়িয়ে পড়েছে অপরাধে। গ্রেপ্তারের দুই থেকে তিন মাস বা কিছুক্ষত্রে এর থেকেও কম সময়ে জামিনে বের হতে পারায় ছিনতাই, রাহাজানি করতে বুক কাপে না কারো। রাজধানীজুড়ে বেশ কয়েকটি ছিনতাই গ্রুপের দাপট রয়েছে। আর গ্রুপের সাথে থাকলে জামিনও মেলে সহজে। কারণ গ্রুপগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন মানুষ। 

শুধু তারাই নয় অগাস্টে হাসিনা পালিয়ে যাবার পরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও আইনের শিথিলতার সুযোগে বেরিয়ে আসে এমন অনেক আসামি যারা তাদের পূর্বের অপরাধের জন্য জেল খাটছিল।  সাথে যেসব সন্ত্রাসীরা আগে সক্রিয় ছিল নীরবে তারা এখন বড় পরিসরে অপরাধ ঘটাতে সাহস করছে। 

প্রশাসন বলছে যারা ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে চাঁদাবাজি করত অগাস্টের পর তাদের ইনকামে বন্ধ হয়ে যায়। তারাই এখন এসব অরাজকতায় জড়িয়ে পড়েছে। 

তবে এখন কোন দল অরাজকতা করছে তা নিয়ে ব্লেম গেম না খেলে আইন প্রয়োগের দুরাবস্থার কথা স্বীকার করতেই হবে। আইন প্রয়োগের অধপতন যেমন নতুন সন্ত্রাসী সৃষ্টি করছে তেমনি বাতাস দিচ্ছে পুরাতন সন্ত্রাসীদেরও। 

পরিসংখ্যান কি বলে

নিজেই যাচাই করে দেখুন পরিসংখ্যান। শিউরে উঠবেন নিশ্চিত। প্রতি নয় ঘন্টায় অন্তত একজন নারী ধর্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশে! এর মানে দাঁড়ায় প্রতিদিন অন্তত দুইজন নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে আমাদের দেশে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশকেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ এর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ৩২৯ টি ধর্ষণের কেইস হয়েছে থানায়। তবে সমাজের চক্ষুলজ্জা আর পরিবারের সম্মানহানীর ভয়ে কত হাজার হাজার মানুষ যে লিগ্যাল একশন নেয় না তার ইয়ত্তা নেই৷ বিশেষজ্ঞদের মতে ১০০ টা ঘটনার মধ্যে প্রায় ৩০ টা ঘটনাই রিপোর্ট করা হয় না। আরও রক্ত হিম করা তথ্য হল প্রতি ৫ জন ধর্ষণের শিকার ব্যাক্তির ৩ জনই শিশু! 

এ তো গেল ধর্ষণের পরিসংখ্যান, ছিনতাই ডাকাতির সংখ্যাটাও আশংকাজনক।

পুলিশ সদর দপ্তরের ক্রাইম ডেটাবেসে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে সারা দেশে মোট ১৫৯টি ‘ডাকাতি’ মামলা করা হয়েছিল, যা নভেম্বরে ছিল ১৩৩টি। ২০২৪ সালে এই মামলার সংখ্যা আগের বছরের ১ হাজার ২২৭টি থেকে বেড়ে ১ হাজার ৪১২টিতে দাঁড়িয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে রাজধানী এবং এর উপকণ্ঠে ৪৩২টি ছিনতাইয়ের জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। এই স্থানগুলোতে কমপক্ষে ৯৭৯ জন ছিনতাইকারী সক্রিয় আছে এবং তাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন থানায় দায়ের করা ফৌজদারি মামলার আসামি।

কেন ভিকটিম মামলা করে না

অনেকে পরিসংখ্যানের হিসাব মিলিয়ে ভাবছেন আমেরিকার তুলনায় বাংলাদেশে তো অনেক কম ছিনতাই, রাহাজানি, ধর্ষণ হচ্ছে। যাক আমার দেশ তাহলে আমেরিকা থেকে অনেকটুক সভ্য। না জনাব ভুলে ভাবছেন। বাংলাদেশের অধিকাংশ ধর্ষণ বা ছিনতাইয়ের কোনো মামলাই হয় না। প্রশ্ন তাহলে কেন সুবিচার পেতে থানায় মামলা করে না ভিকটিম? বাধাটা কোথায়?

– ধর্ষণের ক্ষেত্রে সামাজিক চাপ, পরিবারের সম্মানহানী, কেলেংকারির ভয়ে বেশির ভাগ সময় চুপ হয়ে যেতে বাধ্য হয় ভিকটিম ও তার পরিবার৷  

– যদি চুপ না থাকে, সাহসী পরিবারের প্রতিবাদী কোনো ভিকটিম হয় তাহলেও কম ঝামেলা পোহাতে হয় না তাকে। ধর্ষকের পরিচিত মানুষ থেকে নিত্তনৈমিত্তিক হুমকি ধামকি, আক্রমণ একটা পরিবারকে মেন্টালি ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট। 

– আর ভিকটিম ব্লেমিং খেলা তো বাংলাদেশের মানুষের পুরোনো অভ্যাস৷ এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে ১৮৭২ এর এভিডেন্ট এ্যাক্ট এর দুটি সেকশন পরিবর্তনের জন্য যাতে বলা হয়েছে কোর্টে ভিকটিমের চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন উঠানোর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা থাকবে। যদিও এটি এখনও কার্যকর করা হয় নি। 

– এখন বলতে পারেন মামলা করে ফেললেই হয়৷ বিচার তো হচ্ছেই। তা হচ্ছে। তা কয়টা বিচারের রায় শুনেছেন আজ পর্যন্ত? প্রায় ১০ টা ঘটনার মধ্যে শুধুমাত্র ১ টার মামলা করা হয় থানায়। তাও সে মামলা আদালতে ৮/১০ বছর পর্যন্ত চলতেই থাকে। কোনো চূড়ান্ত রায় হয় না। 

 – কিছু কিছু মিডিয়া তো এক কাঠি সরেস। ভিকটিমের নাম, পরিচয়, ঠিকানা সব প্রকাশ করে দিয়ে ভিকটিমকে সামাজিকভাবে হেনেস্তা করতে পিছ পা হয় না, কিন্তু অপরাধীর নাম, পরিচয় প্রকাশে ঠিকই অনীহা।  এমন হিপোক্রেসি মিডিয়াকে জানানো থেকেও দূরে রাখে অনেককে। 

– অন্যদিকে ছিনতাই প্রসঙ্গে, খোদ পুলিশ কর্মকর্তারাই মনে করেন, ছিনতাইয়ের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে কারণ অনেকেই এসব ঘটনায় মামলা করেন না, আবার অনেকে আইনি ঝামেলা এড়াতে ছিনতাইয়ের ঘটনাকে জিনিসপত্র হারানো গিয়েছে উল্লেখ করে সাধারণ ডায়েরি করেন। অর্থাৎ আইনের ওপর মানুষের আস্থা এতটাই উঠে গেছে যে এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতেই হেনেস্তার ভয় পায় মানুষ। 

আইন শৃঙ্খলার অবস্থা যখন টালমাটাল তখন প্রশাসন কি করছে? 

কিছু পদক্ষেপ ইতোমধ্যে নিয়েছে প্রশাসন। আতঙ্কিত দেশবাসীকে নিরাপত্তা দিতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছে সাথে যুক্ত হয়েছে টহল টীম। মহাসড়কগুলোতে বাড়ানো হয়েছে চেকপোস্টের সংখ্যা। ২০২৪ সালের শেষ চার মাসে রাজধানীতে বিশেষ অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, অভিযান চলাকালীন ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত ৮৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু এমনই আইনের ফাঁক ফোকর আমাদের যে অনেক ছিনতাইকারী নাকি জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারও ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়েছে। এটা আমি বলছি না, বলছেন র্যাবের ডিজি। এর মধ্যে ২৪ শে বনশ্রীর বহুল আলোচিত ছিনতাইয়ের ঘটনার পরে ২৫ তারিখে তড়িঘড়ি করে ডিফারেন্ট স্ট্রেটিজি প্লান করে প্রশাসন। র্যাব, পুলিশ ও এন্টি টেরোরিজম বাহিনীর যৌথ অভিযান শুরু করছে ঢাকার ভেতর। প্রতি পদক্ষেপেই আশা দেখানোর চেষ্টা চলছে যেখানে সত্যি বলতে ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই নজরে আসছে না। 

সবার মনেই ঘাপটি মেরে আছে একটি প্রশ্ন। এই অরাজকতার  কি কোনো রাজনৈতিক যোগসূত্র আছে?

হঠাৎ তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের জন্য চাপ সৃষ্টি, আইন শৃঙ্খলার ভয়ংকর অবনতি, নিরাপত্তা বাহিনীর নির্লিপ্ততা সবকিছুই কেমন সন্দেহজনক ঠেকছে না? 

যেমন এই কদিন আগেই ঢাকা আরিচা মহাসড়কে গাড়ি থামিয়ে ডাকাতি চলছিল। ঘটনাস্থলের এক প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষায় ৯৯৯ এ কল দিয়েও সাহায্য পায় নি । উল্টো জবাব এল “ডাকাতি হচ্ছে ওইখানে আপনি কি করেন? আপনি রাতে ঘুমান না?” না, প্রশাসন ঘুমিয়ে আছে তাই ঘুমাতে পারছে না জনগণ।

অগাস্টের পর থেকে রাজনীতির গদি পেতে বারবার হয়েছে ষড়যন্ত্র। কখনো দেশে হিন্দুদের উপর নির্যাতন হওয়ার মিথ্যা অভিযোগ তুলে কখনো বা দেশটাকে মৌলবাদীদের হাতে তুলে দিলো বলে। কেউ ক্ষমতায় বসতে চায়, কেউ বা ফিরতে চায় গদিতে। কখনো মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে কখনও কর্মীদের কখনও বা সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে একটা শ্রেণি। পেছনে কে কলকাঠি নাড়ছে?  ছিনতাই গ্রুপগুলোকে প্রশয় দিচ্ছে কারা? কেন নিরাপত্তা বাহিনী নির্লিপ্ত? রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ফ্যাসিবাদ ঢুকিয়ে গেছে হাসিনা সরকার তা দূর করা চাট্টিখানি কথা না।

কি করতে হবে

সমস্যা অনেক। কিন্তু সমাধান কি নেই? অবশ্যই আছে। আমাদেরকে এখন খুজে বের করতে হবে এমন সমাধান যাতে দেশের এই মরণ ব্যাধিকে শিকড়সহ উপড়ে ফেলা যায়। আদো কতটুকু সম্ভব হবে জানি না, কিন্তু সবাই মিলে চেষ্টা করলে কিছু না কিছু তো হবেই। 

-প্রথমেই উচিত ধর্ষণের মত গুরুতর অপরাধগুলোকে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে দ্রুত সম্পন্ন করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেয়া। এবং তা গণমাধ্যমে প্রচার করলে সেটি অপরাধীদের জন্য একটি সতর্কমূলক বার্তা বহন করবে। পাশাপাশি গণমাধ্যমগুলোতে শাস্তির কথা প্রচার করতে হবে ঢাক ঢোল পিটিয়ে যেন অপরাধীরা ১০০ বার চিন্তা করে। 

– যদি থানায় ধর্ষণ মামলা না নেয় তবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে এফিডেভিডের মাধ্যমে ধর্ষণকারী ব্যক্তিটিকে আবেদন করতে হবে এমন ভাবে যে আপনাকে ধর্ষণ করা হয়েছে বা আপনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন কিন্তু থানা মামলা নিচ্ছে না। তাহলে আদালত নিজ উদ্যোগে মামলাটি গ্রহণ করতে পারবে পিটিশন কেস হিসেবে। অথবা আদালত চাইলে থানাকে নির্দেশ দিতে পারে যে মামলাটিকে FIR হিসেবে গণ্য করার জন্য। তখন থানা মামলাটি নিতে বাধ্য থাকবে। 

-সমাজের প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অনিয়ম বন্ধের দায়িত্ব শুধু প্রশাসনের না। কোনো সন্দেহজনক অবস্থা দেখলে বা কারো সাথে অন্যায় হতে দেখলে আশে পাশের সবাই মিলে এগিয়ে আসুন। গুলি করলে যায় একটা বাকিডি যায় না। মনে আছে তো না? সবাই মিলে এগিয়ে আসলে অপশক্তি পরাজিত হতে বাধ্য। জুলাইয়ের আন্দোলনই  আমাদের সামনে চাক্ষুষ প্রমাণ। 

– মানুষের আদিম শিক্ষাঘর হল পরিবার। নিজেদের সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের নৈতিক মূল্যবোধ জাগাতে হবে ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই। নারীর প্রতি সম্মান, নৈতিকতা নিয়ে পরিবারে আলোচনা করুন। আপনি বা আপনার কোনো আপনজন যেন সমাজের জন্য বিষফোঁড়া না হয় সেটা খেয়াল রাখার দায়িত্ব আপনারই। 

অন্য জনের মা, বোন সম্ভ্রম হারাচ্ছে কিংবা রাস্তায় অন্য রিকশায় ছিনতাই হতে দেখে চুপ করে আছেন? আজ অন্য জনের উপর আঘাত আসছে, কাল যে আপনার উপর তা আসবে না সেটার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? সমাজ পচে যাওয়া শুরু করলে কিন্তু সেই পচনের অংশ হয়ে যায় সবাই। এর থেকে বাচা সম্ভব না ততক্ষণ যতক্ষণ না আপনি আমি আওয়াজ তুলব। 

সবশেষে কাজী নজরুলের ভাষায় বলতে চাই দুলিতেছে তরী ফুলিতেছে জল ভুলিতেছে মাঝি পথ, ছিড়িয়াছে পাল কে ধরিবে হাল আছে কার হিম্মত? এখনই সময় হিম্মত দেখিয়ে এগিয়ে আসার। দেশের হাল ধরার। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top