How does mummies made in egypt?

কীভাবে প্রাচীন মিশরে মমি বানানো হত?

মরে গেলে মিশে যেতে হবে মাটিতে।  কিন্তু প্রচলিত এই প্রথা ভেংগে প্রাচীন মিশরে মারা যাবার পর মৃতদেহ যাতে পঁচে না যায় সেজন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লাশকে মমি করা হত। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় মমিফিকেশন। প্রাচীন মিশরীয়দের মধ্যে বিশ্বাস ছিল যে মরে যাবার পর তাদের শরীর যত দিন অক্ষত থাকবে ততদিন তারা স্বর্গে বসবাস করতে পারবে। এজন্য তাদের মৃতদেহের সাথে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, পরকালে বিলাসবহুল জীবনের জন্য স্বর্ণ অলংকারও দিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু যেখানে প্রকৃতির নিয়মই মরে যাওয়ার সাথে সাথে শরীরে পচন ধরা সেখানে কিভাবে মিশরীয়রা দেহকে অক্ষত রাখত? 

মৃতদেহ সংরক্ষণের কি প্রয়োজনীয়তা ছিল? 

মরে গেলেও শরীরের প্রয়োজন হবে এ বিশ্বাস থেকে মমিফিকেশনের শুরু। তাদের বিশ্বাস অনুসারে মারা যাবার পর মৃত্যুর পরের জীবনে সৃষ্টার সামনে উপস্থিত হতে হবে তাই সৃষ্টার সামনে পবিত্র রুপে হাজির হওয়ার জন্য মৃতদেহের মমির প্রক্রিয়া সংঘটিত হত।

মমি বানানোর প্রথার সূচনা 

মমির কথা বললেই প্রথমেই চোখে ভাসে মিশরের কথা। কিন্তু পৃথিবীর আরো অনেক দেশের সংস্কৃতিতে মমি পাওয়া গেছে। ইরান, আফ্রিকা, চায়না, ক্যানারি আইসল্যান্ড, লিবিয়া ইত্যাদি। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে খ্রিষ্টের জন্মের সাড়ে তিন হাজার বছর আগে থেকে এর সূচনা। মিশরে সবচেয়ে প্রাচীন যে মমি পাওয়া গেছে তা ৪৩০০ বছর আগের। এ সময়কে বলা পিরামিডের যুগ। চিলিতে নয় হাজার বছর আগের সভ্যতা চিংকোরো, তারাও মৃতদেহকে সংরক্ষণ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। ইনকা, অ্যাজটেক, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী, আফ্রিকার কিছু গোত্রও মৃতদেহ সংরক্ষণের পদ্ধতি জানত। মিশরীয়রা প্রথম দিকে মৃতদেহকে মাটিতে পুতে ফেলত। মরুভূমির শুষ্ক আবহাওয়ায় লাশের দেহের আর্দ্রতা টেনে ফেলত ফলে প্রাকৃতিকভাবেই মমিতে পরিণত হত মৃতদেহ। কিন্তু কফিন ব্যাবহার শুরুর পর থেকেই সমস্যার শুরু। কফিনে মৃতদেহ পঁচে যেত। 

মমি বানানোর সূচনা; Image Source: Unsplash

মমি বানানোর প্রক্রিয়া

মমি বানানোর প্রক্রিয়া খুবই জটিল, পরিশ্রমের ও সময় সাপেক্ষ কাজ ছিল। প্রচুর ব্যায়বহুল এ মমিফিকেশন করার জন্য প্রয়োজন ছিল গভীর জ্ঞানেরও। সবার এ প্রক্রিয়া জানার উপায় ছিল না। দেহ সংরক্ষণের জন্য যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় তাকে বলা হয় এম্বামিং। যারা এ কাজ করতে পারত তাদের বলা হত এম্বামার।তারা পুরোহিতদের সমান সম্মান পেতেন। মমি তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় কোনো ব্যক্তি মারা যাবার চতুর্থ দিন থেকে। প্রায় ৭০ দিন সময় লাগত একটি মৃতদেহকে মমিতে রুপান্তর করতে। 

মমিফিকেশন; Image Source: Pexels

প্রথমে ভালো করে ধুয়ে ফেলা হত।  এরপর শরীরের অঙ্গপ্রতঙ্গ বের করে আনার পালা কারণ ভেতরের  অঙ্গপ্রতঙ্গগুলো খুব দ্রুত পচন ধরতে শুরু করে। সবার প্রথমে নাক দিয়ে বিশেষ একটি হুক ঢুকিয়ে মস্তিষ্ককে গুড়িয়ে ফেলা হত। যাতে এটি তরল হয়ে সহজে বের হয়ে আসতে পারে। তারপর পেটের বাম দিকে কাটা হত যাতে ভেতরের অংগপ্রতংগ বের করে আনা যায়। যেমন পাকস্থলী, কিডনি, অন্ত্র, ফুসফুস, কলিজা। এগুলো বের করে শুকিয়ে, একটি বিশেষ ধরনের পাত্রে সংরক্ষণ করা হত। এ পাত্রকে বলা হয় কেনোপিক জার। প্রত্যেক অঙ্গের জন্য আলাদা জার রয়েছে। শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ গুলোর মধ্যে শুধুমাত্র হ্রদপিন্ড রেখে দেওয়া হত কারণ তারা মনে করত এটি সব জ্ঞান, অনুভূতির মূল উৎস। তারা বিশ্বাস করত এই হ্রদপিন্ডের ওজন পরিমাপ করে পরকালে স্রষ্টা স্বর্গ ও নরক নির্ধারণ করবে। অর্থাৎ যার হ্রদপিন্ডের ওজন কম হবে তার জন্য তা সুফল বয়ে আনবে।যদিও পরবর্তীতে আবার সব অঙ্গ প্রক্রিয়াজাত করে শরীরে রেখে দেওয়ার রীতি চালু হয়। তবে রীতিনীতির অংশ হিসেবে খালি কেনোপিক জারও রেখে দেওয়া হত। পরবর্তী ধাপে পেটের কাটা অংশ দিয়ে এম্বামিং ফ্লুইড নামক তরল পদার্থ দ্বারা পুরো শরীরের ভেতর পরিস্কার করে নেয়া হত। বিভিন্ন ধরনের ভেষজ ও সুগন্ধি দ্রব্য শরীরের ভেতরে রেখে দেওয়া হত। অতপর কাটা অংশ জোড়া দিয়ে পুরো শরীরে ভ্যাজিটেবল ওয়েল মাখানো হত। এই ধাপ পর্যন্ত প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লাগত। পরবর্তী ধাপে দেহকে ন্যাট্রোন নামক লবণ দিয়ে ঢেকে রোদে শুকাতে দেওয়া হত। এ লবণ পুরো শরীরের আর্দ্রতা শুষে নিত এবং এতে সময় লাগত প্রায় ৩৫-৪০ দিন। শরীরের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলোকেও একই ভাবে শুকানো হত। এগুলোকে শুকিয়ে চারটি কেনোপিক জারে রাখা হত। প্রায় ৩৫-৪০ দিন পর মৃতদেহের আর্দ্রতা শুকিয়ে গেলে তা পরিষ্কার করে তেল দেয়া হত। পুরো শরীরে প্রায় ২০ স্তরে পেচানো হত লিলেনের কাপড়। কাপড় যাতে খুলে না আসে তাই কাপড়ের জোড়া গুলোর মাঝে বিশেষ আঠা ব্যবহার করা হত। কাপড় পেচানোর সময় বিভিন্ন তাবিজ মন্ত্র পড়ে লাশের শরীরে বেধে দেয়া হত।  তাবিজ গুলো দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল পরকালের অনিষ্ট থেকে বাচানো। প্রাচীন মিশরীয় মমিগুলোতে সবচেয়ে বেশি যে তাবিজ পাওয়া গেছে তা ছিল ‘ আই অফ হরুস’ যা শয়তানি শক্তি থেকে মৃতদেহকে বাচানোর জন্য দেয়া হত।  পুরোহিতগণ ডেথ মাস্ক নামক বিশেষ মুখোশ মমির মুখে পড়িয়ে দিতেন। কাপড় পেচানো শেষ হতে সময় লাগত ১৫-২০ দিন। অতপর মমিকে কফিনে রেখে দেওয়া হত। 

মমিফিকেশন করার জন্য প্রয়োজন ছিল গভীর জ্ঞানের; Image Source: Unsplash

মমিগুলোকে যুগের পর যুগ টিকিয়ে রাখতে ও আবহাওয়ার ক্ষয় থেকে বাচাতে কফিন গুলোকে মাটির গভীরে দাফন করা হত।  মিশরীয় ফারাও সম্রাটরা তো রীতিমতো পিরামিড তৈরি করেছে তাদের মমির সুরক্ষার জন্য। তবে উচ্চ পদস্থ লোকদের মমির সুরক্ষার জন্য একাধিক কফিনও ব্যবহার করা হত। এমনকি কেউ যেন মৃতদেহ অবধি না পৌঁছাতে পারে তার জন্য পাথরের কফিন ও ব্যবহৃত হয়েছে। 

কফিনে কি কি থাকত?

মিশরীয়রা মনে করত মৃত্যুর পরও তাদের যে জীবন থাকবে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে করে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। তারা বিভিন্ন কাজের জন্য যেমন খাবার বানানো, মদ বানানো, আসবাবপত্র বানানো, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ইত্যাদি আরও অনেক ধরনের দাস কফিনে ছোট মূর্তি আকারে বানিয়ে রাখত। তাদের ধারণা মতে শবতিস নামের মানুষের আকৃতির এসব মূর্তি গুলো পরকালে জীবন ফিরে পাবে এবং মৃতের পরবর্তী জীবনে দাসত্ব করবে। যে যত বিত্তশালী ছিল তার কফিনে তত বেশি পুতুল সদৃশ দাস রাখা হত। 

কাদের মমি করা হত?

প্রাথমিক যুগে শুধুমাত্র রাজা বা সম্রাটদের মমি বানানো হত। পরবর্তীতে সমাজের উচ্চ পদস্থ ও গুরুত্বপূর্ণ  লোকদেরও মমি বানানো হত। ধীরে ধীরে সাধারণের জন্যও উন্মুক্ত হয়ে যায় পদ্ধতিটি। চতুর্থ শতক থেকে হারিয়ে যেতে থাকে মিশরের মমি করার রীতি। খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার ও প্রসারের সাথে সাথে মমি করার রীতিও বিলুপ্ত হতে থাকে। 

উচ্চ পদস্থ মানুষদের মমি করা হত; Image Source: Unsplash

কেন কফিনে চুরি হতে থাকে?

মিশরীয়রা মনে করত মারা যাওয়ার পর অর্থ সম্পদ কাজে লাগে। তাই তাদের কফিনে থাকত দামী অলংকার, স্বর্ণ, মুদ্রা। যা পরবর্তীতে চোর, ডাকাতদের জন্য বিশাল আকর্ষণ হয়ে ওঠে। মানুষের এসব প্রাচীন ধন সম্পদ পাবার লোভে চুরি গেছে বহু মমি, বারবার আঘাত হানা হয়েছে প্রাচীন মমিগুলোর কফিনে। তবে বহু বছর পরেও ভীষণ সুরক্ষায় রাখা লুকায়িত কিছু ফারাও মমি বিশেষজ্ঞগ্ণ অক্ষত অবস্থায় খুঁজে পেতে সক্ষম হন। সেসকল মমি থেকে প্রাচীন যুগের অনেক রহস্য, সংস্কৃতি, রীতি নীতি ,মানুষের জীবন, ভাষা সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়েছে।

মৃতদেহ সুরক্ষার জন্য অকল্পনীয় রহস্যময় পিরামিডের মত এত বড় নিদর্শন নির্মাণের জন্য মিশর আজ পৃথিবীর মানুষের জন্য অন্যতম জনপ্রিয় জায়গা। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top