অপারেশন কিলো ফ্লাইট। এই অপারেশনটা মুক্তিযুদ্ধের একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ এই নামটার সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্মের কাহিনী। কিভাবে যুদ্ধের মত ভয়াবহ পরিস্থিতির মাঝে তৈরি হয়ে গেল পুরদস্তুর একটা বিমান বাহিনীর টীম? কেমন ছিল বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম ফ্লাইয়িং এক্সপেরিয়েন্স? যার শুরুটাই ছিল মার মার কাট কাট যুদ্ধ দিয়ে। চলুন শুরু করা যাক।
এপ্রিল মাস থেকেই বাঙালিরা যারা পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল তারা পালিয়ে দেশে আসা শুরু করল। স্পেশালি আর্মির লোকজন। পাকিস্তানের বিমানবাহিনী থেকে সেসময় বাঙালিরা পালিয়ে আসছিল। তাদের মাঝে একজন ছিলেন ক্যাপ্টেন শামসুল আলম। তিনি তখন ছিলেন রাওয়ালপিন্ডিতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিমানবাহিনীতে। মার্চ মাসে যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই পাকিস্তানি বিমান বাঙালি পাইলটদের ফ্লায়িং ডিউটি দেয়া বন্ধ করে দিল। সুদূর পাকিস্তান থেকেও যুদ্ধের আঁচ পাচ্ছিল বাঙালিরা। তাই দেশে আসার তাগিদে সেখান থেকে শামসুল আলম পরিকল্পনা করলেন মিথ্যা অযুহাতে ছুটি নিয়ে করাচি যাবেন আর সেখান থেকে পালিয়ে আসবেন বাংলাদেশে। ছুটি এপ্রুভ হল। মে মাসের শেষের দিকে তিনি করাচি আসলেন। করাচি থেকে আবার রাওয়ালপিন্ডিতে না গিয়ে ৩ জুন তিনি এয়ার টিকিটে চলে আসলেন ঢাকাতে। ঢাকাতে নামার পরপরই তাকে তল্লাশি করে পাকিস্তানি অফিসার কর্তৃক এরেস্ট করা হলো। নিয়ে যাওয়া হল ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে একটা কন্সান্ট্রেশন ক্যাম্পে।
সেখানে তাকে জুন, জুলাই, অগাস্ট তিন মাস রাখা হল। এর মাঝে জুন আর জুলাই মাসে প্রায় প্রতিদিনই চলত সেখানে আটকে রাখা বাঙালিদের উপর অকথ্য নির্যাতন। অগাস্ট মাসে কোনোমতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হয় শামসুল আলম। তারপর ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকারের সাথে যোগাযোগ করে তিনি ভারতে চলে আসেন। সেখানে গিয়ে দেখেন বিমানবাহিনীর আরও অনেকে আছে যারা ভারতে এসেছে আরও তিন/চার মাস আগে। আসলে মুক্তিযুদ্ধের মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই মুক্তিবাহিনীর বিমান উইং গঠনের জন্য প্রথমবারের মতো পরিকল্পনা করা হয়েছিল। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের আগরতলায় চলে যান পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বেশ কয়েকজন বাঙালি অফিসার। উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধে যোগদান। এই অফিসারদের মধ্যে ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খন্দকার, উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার, স্কোয়াড্রন লীডার এম সদর উদ্দিন, ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম।
ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খন্দকার আর তাজউদ্দীন মিলে আরও তিন/চার মাস আগ থেকেই ভারত সরকারের কাছে ফাইটার প্লেন দেয়ার জন্য অনুরোধ করে যাচ্ছিল। বারবার তারা জানাচ্ছিল আমাদের টেকনেশিয়ান আছে, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত পাইলট আছে জাস্ট প্রয়োজন প্লেনের। কিন্তু কোনোভাবেই তাদের রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করা হচ্ছিল না। প্লেন উড়ানোর জন্য বিশাল রানওয়ে আর ইনফ্রাস্ট্রাকচার লাগত। এটা ছিল একটা বড় বাধা। আবার বাংলাদেশকে মাঝে রেখে ভারত আর পাকিস্তানের মাঝে এক প্রকার প্রক্সি ওয়ার চলছিল বটে কিন্তু ভারতের এয়ারবেইজ ব্যবহার করে যদি বাংলাদেশের পক্ষের কোনো বিমান উড়ত আর সেটা পূর্ব বাংলায় এসে কোনোভাবে ক্রাশ করত তাহলে সেটা আন্তর্জাতিকভাবে জানাজানি হলে ভারত আর পাকিস্তানের মাঝে অফিশিয়ালি যুদ্ধ লেগে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল। তাই এই রিস্ক নেয়া ছিল অসম্ভব।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে তাজউদ্দীন তার অফিসে ভারত সরকারের সচিব কেবি লাল, ভারতীয় বিমানবাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ডার এয়ার মার্শাল হরি চান্দ দেওয়ান ও একজন সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে বিমানবাহিনী গঠন নিয়ে আলোচনা করার জন্য একে খন্দকারকে ডেকে পাঠান। কিন্তু ফলাফল শূন্য। বিমান দেয়ার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে উল্টো ভারতীয় কর্মকর্তারা প্রস্তাব দেয় যেন বাঙালি অফিসাররা ভারতীয় স্কোয়াড্রনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু এ.কে. খন্দকার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। সাথে বাংলার নিজস্ব বিমানবাহিনী গঠন করার পরিকল্পনার উপরই অটল থাকেন।
আগস্টের শেষদিকে ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল পিসি লাল কলকাতা সফরে এলে একে খন্দকার তার সঙ্গে দেখা করে একই প্রস্তাব দেন। পিসি লাল তাৎক্ষণিক কোনো পজিটিভ উত্তর দিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত একে খন্দকারের প্রস্তাবই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে একে খন্দকারকে জানানো হয়, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠনে ভারতীয়রা সম্মত হয়েছেন। তারা বাংলাদেশ সরকারকে একটি কানাডিয়ান অটার বিমান, একটি ফ্রেঞ্চ অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার এবং একটি ডিসি-৩ ডাকোটা (সি-৪৭) বিমান হস্তান্তর করে। ডাকোটা বিমানটি ছিল যোধপুরের মহারাজের ব্যক্তিগত বিমান। উনি এই বিমান বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। তবে ভারতের দেওয়া বিমান তিনটি কিন্তু মোটেও কোনো যুদ্ধবিমান ছিল না। এগুলো ছিল মূলত বেসামরিক বিমান।
যাই হোক, এ তিনটি বেসামরিক এয়ারক্রাফটকে সেসময় যুদ্ধ বিমানে পরিণত করতে নানান কারিগরি বুদ্ধি খাটাতে হয়েছিল। এক কথায় প্রচুর শ্রম দিতে হয়েছিল।
ডাকোটাটিকে ৫০০ পাউন্ড বোমা পরিবহনের উপযোগী করে তোলা হয়েছিল। হেলিকপ্টারটিতে বাড়তি সুরক্ষার জন্য এর মেঝেতে এক ইঞ্চি পুরু স্টিলের পাত ঝালাই করে লাগানো হয়। এছাড়াও এতে থ্রি-নট-থ্রি ব্রাউনিং মেশিনগান এবং ১৪ টি রকেট ছোঁড়ার পাইলন বসানো হয়েছিল। অতিরিক্ত ভারের জন্য এটি বেশ নড়বড়েভাবে উড়ত। মেরামতের পর এটি নভেম্বরে এর প্রথম যাত্রা সম্পন্ন করে। ঘণ্টায় ৮০ মাইল গতির অটার বিমানটির প্রতিটি ডানার নিচে ৭টি করে রকেট ছিল এবং এর ২৫ পাউন্ড বোমা বর্ষণের ক্ষমতা ছিল। পেছনের দরজা খুলে লাগানো হয়েছিলো মেশিনগান, মেঝের পাটাতন খুলে ২৫ পাউন্ডের ১০টি বোমা বসানো হয়েছিলো। বোমাগুলো আবার অটোমেটিক ছিল না, হাত দিয়ে পিন খুলে নিক্ষেপ করতে হতো। পুরো ব্যাপারটা আদতে অনেক কঠিন ছিল।
ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার বলেন, ‘আমরা এয়ারক্রাফটগুলোর তলদেশে বুলেট থেকে রক্ষার জন্য ১ ইঞ্চি স্টিল প্লেট লাগালে দেখা যায় অটারের সেন্টার গ্রেভিটি নষ্ট হয়ে গেছে। সেটা আবার ঠিক করা হলো। এসব কাজ ছিল প্রচন্ড ঝুঁকিপূর্ণ।’
বিমান তো হল এখন প্রয়োজন যুদ্ধের প্রস্তুতির প্রশিক্ষণের জন্য এয়ারফিল্ড। ভারত সরকার বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে গোপনে প্রশিক্ষণের জন্য দিল নাগাল্যান্ড প্রদেশের ডিমাপুরের একটি পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ড। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত ডিমাপুরের বিমানঘাঁটিটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিত্যক্ত। জায়গাটা ছিল ঘন জঙ্গলে, উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা আর সাপ-খোপে ভরা। ৫ হাজার ফুটের রানওয়েটাও ছিল অমসৃণ। এমন একটা এয়ারফিল্ডে বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ দুইটাই ছিল খুব রিস্কি। কিন্তু তখন এই ভাঙাচোরা এয়ারফিল্ডই শেষ ভরসা।
বীর উত্তম খেতাব প্রাপ্ত ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা ২০০-২৫০ মিটারের চেয়ে বেশি উঁচুতে উড়তে পারতাম না এবং যে কোনো সময় পাহাড়ে বিধ্বস্ত হবার ঝুঁকি ছিল। কিন্তু আমরা ঐ আকাশযানগুলো নিয়ে খুব কম সময়ের মধ্যেই প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছিলাম।’
শুরু হলো কঠোর প্রশিক্ষণ। বেসামরিক বিমানগুলো সম্পর্কে বৈমানিকদের তেমন ধারণা না থাকায় ভারতীয় প্রশিক্ষক স্কোয়াড্রন লিডার সঞ্জয় কুমার চৌধুরী ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ঘোষালের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। সব প্রতিকূলতাকে তুচ্ছ করে সকাল-বিকাল, স্পেশালি রাতের বেলায় চলতে থাকে উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ। এই ধরনের ট্রেনিংয়ে সাধারণত কমপক্ষে প্রস্তুতির জন্য ৪ মাস সময় লাগে, অথচ বাঙালি বৈমানিকদের হাতে ছিল মাত্র ১৫ দিন। প্রথমে ১০ দিনেই বিমান নিয়ন্ত্রণে চলে আসল তাদের । পরিকল্পনা ছিল রাতের আক্রমণ করা। কারণ দিনে আক্রমণ চালালে পাকিস্তানের অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান ও মিসাইল ব্যবস্থার সামনে টেক্কা দেয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। তাই রাতের আধারে আক্রমণ করার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি চলতে থাকে। প্রশিক্ষকরা ২৫ মাইল দূরে পাহাড়ের চূড়ায় প্যারাসুট ফেলে রাখত বৈমানিক মুক্তিযোদ্ধারা ওই প্যারাসুটকে লক্ষ্য করেই টার্গেট ছুঁড়ত। ঠিক করা হয়, প্রতিটি বিমানেই থাকবেন ৩ জন করে পাইলট। এর মধ্যে ১ জন স্ট্যান্ডবাই। যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কোনো পাইলট আহত বা অসুস্থ হলে তখন তিনি দায়িত্ব পালন করবেন। একইসঙ্গে থাকবেন একজন করে গানার।
প্রশিক্ষণ যখন প্রায় শেষের দিকে তখন চন্দন সিং, সুলতান আহমেদসহ বাকিদেরকে একটি প্রতীক ঠিক করতে বলেন যা অস্ত্রসজ্জিত হেলিকপ্টারে আঁকা হবে। আলোচনার পর ঠিক হয় হেলিকপ্টারের ভার্টিকাল স্ট্যাবিলাইজারের উপর গোলাকার লাল চাকতির ওপর বসানো থাকবে সবুজরঙা বাংলাদেশের মানচিত্র। হেলিকপ্টারটির সিরিয়াল নম্বর আইএএফ ৩৬৪ থেকে পাল্টে ইবিআর (ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলস) করা হয়।
১৯৭১-এর ২৮ সেপ্টেম্বর। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিশেষ একটা দিন। এদিন শুরু হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর শুরু হয়। গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার বিমানবাহিনীর বিভিন্ন দায়িত্ব বণ্টন করে দেন। তিনি স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদকে এই ফরমেশনের অধিনায়ক নিযুক্ত করেন। অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার এবং অটার বিমান নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বৈমানিকদের দুভাগে ভাগ করা হলো। হেলিকপ্টারের ক্যাপ্টেন হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয় স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদকে এবং কো-পাইলট হিসাবে নিয়োজিত হন ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম ও ক্যাপ্টেন শাহাবউদ্দিন।
অটার বিমানের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম এবং কো-পাইলট হন ক্যাপ্টেন আকরাম ও ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন। অপরদিকে ডাকোটা বিমানের ক্যাপ্টেন নিয়োজিত হন ক্যাপ্টেন খালেক এবং কো-পাইলট হিসাবে নিযুক্ত হন ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার ও ক্যাপ্টেন মুকিত।
সিদ্ধান্ত হয়, ২ নভেম্বর রাতে ডাকোটা বিমান দিয়ে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে আক্রমণ চালানো হবে। আক্রমণটি করবেন ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার, ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক ও ক্যাপ্টেন আবদুল মুকিত। কিন্তুশেষ মুহূর্তে এসে স্থগিত করা হয় অপারেশনটি।
নভেম্বরের মাঝামাঝি ৬৬ দিনের প্রশিক্ষণ শেষ হলে আবার আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এইবার ঠিক করা হয় বিমান আক্রমণের প্রথম পর্বে হামলা চালানো হবে পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারি ও নারায়ণগঞ্জের জ্বালানি তেলের ডিপোতে। কারণ এই ডিপো গুলো থেকেই পাকিস্তানি বিভিন্ন বাহিনীতে জ্বালানী সরবরাহ করা হত। এর মাঝে গেরিলারা বেশ কয়েকবার এই ডিপোগুলোতে আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়েছিল। ঠিক হয় স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও তার কো-পাইলটরা হেলিকপ্টার নিয়ে নারায়ণগঞ্জ এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ও তার কো-পাইলটরা অটার বিমান নিয়ে পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারির তেল ডিপোতে বিমান আক্রমণ করবেন। আক্রমণের তারিখ নির্ধারণ হয় ২৮ নভেম্বর। এ ঐতিহাসিক অপারেশনের নামকরণ করা হয় গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারের নামের ইংরেজি প্রথম বর্ণ ‘কে’ অনুসারে ‘অপারেশন কিলো ফ্লাইট’। সব যখন একদম ঠিকঠাক তখন হুট করেই স্থগিত হয়ে যায় ২৮ নভেম্বরের মিশন। দেশের জন্য কিছুটা একটা করার অপেক্ষায় অস্থির হয়ে থাকা বিমানবাহিনীর সদস্যদের জন্য সেটা ছিল প্রচন্ড হতাশার।
তবে আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় নি। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী সরাসরি ভারতীয় এয়ারবেইজে হামলা করার সাথে সাথে পরিস্থিতি পালটে যায় ১৮০° এংগেলে। পাকিস্তানি হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বার্তা আসে যে, সে রাতেই কার্যকর করা হবে অপারেশন কিলো ফ্লাইট । টার্গেট টাইম ছিল একটাই রাত ১২ টা বেজে ১ মিনিট।
৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পর্যাপ্ত জ্বালানি ও রকেট নিয়ে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ তার সঙ্গীসহ হেলিকপ্টার নিয়ে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। সন্ধ্যার পর তারা ভারতে তেলিয়ামুরা বিমানঘাঁটি ছেড়ে রওয়ানা দেন নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে। রাতের অন্ধকারে হেলিকপ্টার দেখা না গেলেও আওয়াজের কারণে তার অস্তিত্ব ঠিক টের পাওয়া যাচ্ছিল। তেলিয়ামুরা থেকে কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ হয়ে ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়ক ধরে হেলিকপ্টার নায়ারণগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ডেমরায় পৌঁছে যায়। তারপর দক্ষিণে মোড় নিয়ে সোজা নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের তেলের ডিপো এলাকায় পৌঁছায়। রাতের অন্ধকারে হেলিকপ্টারের আওয়াজে সবাই চমকে ওঠে। এ সময় সুলতান মাহমুদ হেলিকপ্টার নিয়ে তেলের ডিপোর ওপর বেশ কয়েকবার চক্কর দিয়ে বেশ কয়েকটি রকেট নিক্ষেপ করেন। রকেট নিক্ষেপের পর বিকট শব্দে তা বিস্ফোরিত হয়। হঠাৎ করেই যেন রাতের অন্ধকার ভেদ করে আগুনের শিখায় চারদিক আলোকিত হয়ে উঠল। তাদের এ আচমকা হামলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।
এরপর তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই সুলতান মাহমুদ ও তার দল তেলের ডিপোর ব্যাপক ক্ষতি করতে সক্ষম হন। অপারেশন সম্পন্ন করে তারা সহজেই পূর্বনির্ধারিত বিমানঘাঁটিতে ফিরে আসেন।
অন্যদিকে, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম অটার বিমান নিয়ে সন্ধ্যা আটটায় তার দলবলসহ বাংলাদেশের শমশের নগরের উলটো পাশে ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাস শহর এয়ারফিল্ড থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওয়ানা দেন। রওয়ানা হওয়ার পর অটার বিমান প্রথমে এক হাজার ফুট উচ্চতায় উড়তে শুরু করে। তারপর পাকিস্তানি রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য উচ্চতা কমাতে কমাতে একশ ফুটে নেমে আসে। রাতের অন্ধকারে নেভিগেশন সিস্টেম না থাকায় গন্তব্যের পথ ঠিক রাখার জন্য তিনি ফেনী নদী বরাবর অগ্রসর হতে থাকেন।
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর শামসুল আলম বুঝতে পারেন তারা বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে গেছেন। তারপর বামে মোড় নিয়ে তেল শোধনাগারের দিকে উড়ে যান। কিছুদূর যাওয়ার পর চাঁদের আলোয় তিনি দেখতে পেলেন চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের রানওয়ে। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই লক্ষ্যবস্তুর ওপর চলে আসে অটার বিমান। চলে এসেছেন ইস্ট্রার্ন রিফেনারীর উপরে। নিচে সারি সারি তেলের ট্যাংকার। শামসুল আলম আক্রমণের জন্য তৈরি হয়ে প্রথমেই তেলের ট্যাংকার বরাবর দুটো রকেট নিক্ষেপ করেন। রকেট দুটো তেলের ট্যাংকারে হিট করলেও বিস্ফোরণ হলো না। এভাবে তিনি দ্বিতীয়বারও চেষ্টা করেন। তৃতীয় আক্রমণের প্রস্তুতি নিতেই বিমানবন্দরের দুদিক থেকে শত্রুর ছয়টি বিমানবিধ্বংসী কামান গর্জে ওঠে। তবে বিমানে আঘাত করতে পারল না কামানের বারুদ। এরপর তিনি তৃতীয় আক্রমণ করেন। এবার রকেট ডিপোর মধ্যখানের একটি ট্যাংকে গিয়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। রকেট বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্যাংকটিতে দাউ দাউ করে আগুন ধরে যায়। অতঃপর এক ট্যাংকার থেকে আরেক ট্যাংকারে আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
শামসুল আলম পুরো অপারেশনে একে একে ১৪টি রকেট নিক্ষেপ করেন। আগুনের লেলিহান শিখা তখন এত উচ্চতায় উঠেছিল যে, মিজোরাম থেকেও সে আগুন দেখা যাচ্ছিল। শত্রুপক্ষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই অপারেশন কিলো ফ্লাইটের যোদ্ধারা তেলের ডিপো এলাকা থেকে দূরে সরে আসেন। এবার তাদের ফিরে আসার পালা। লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানো কঠিন ছিল; কিন্তু ফেরত যাত্রা ছিল আরও কঠিন। অনেক সতর্কতার সাথে দিক নির্ধারণ করে, সময় ও গতি বিবেচনায় রেখে কুম্ভীগ্রাম বিমানবন্দরে নিরাপদেই ফেরত আসেন তারা। নারায়ণগঞ্জ আর পতেঙ্গায় জ্বালানি তেলের ডিপো ধ্বংসের লেলিহান শিখার সাথে অনেকটুকু জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় পাকিস্তানের জেতার সম্ভাবনাও।
কিলোফ্লাইটের ৪৮ ঘন্টার অপারেশনে সবার প্রথমে বাংলার আকাশ স্বাধীন হয় ডিসেম্বরের ৫ তারিখে।
সব মিলিয়ে ৪-১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার দিয়ে প্রায় ৭৭ টি আর অটার দিয়ে ১২ টি আক্রমণ চালানো হয়। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী নিজস্ব দ্বিতীয় বিমান হামলাটি করে ৬ ডিসেম্বর সিলেটের মৌলভীবাজারের সেনা ছাউনিতে। এ আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, কো-পাইলট হিসেবে ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন। এদিকে ডিমাপুর থেকে ঘাঁটি সরিয়ে শমসেরনগর নেয়া হয় এবং পরবর্তীতে যুদ্ধ শেষ হবার আগে তা আগরতলায় স্থানান্তর করা হয়। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট ও ভৈরবসহ মোট ১২টি অপারেশনে কিলো ফ্লাইট বীরত্বের সাক্ষর রাখে। ৫-১১ ডিসেম্বরের মধ্যে জামালপুর, মেঘনা নদী ও নরসিংদীর অপারেশনেও কিলোফ্লাইট অংশ নেয়।
কিলো ফ্লাইট বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম ফ্লাইং ইউনিট যা জন্মের ৬৬ দিনের মাথায় কার্যকরী হয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছিল। যেখানে দুর্দান্ত প্রতাপের সাথে বাংলাদেশের বৈমানিকরা আয়েশি জীবনের অপশন ফেলে জাস্ট অল্প কদিনের প্রশিক্ষণে মৃত্যুর পরোয়া না করে স্বাধীন করেছিল বাংলার আকাশ। মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি সশস্ত্রবাহিনীর ইতিহাসে তাই কিলোফ্লাইট এক উজ্জ্বল নাম যেখান থেকে শুরু হয়েছিল একটি নতুন অধ্যায়।




